শিরোনাম
ঢাকা, ১৪ জুন ২০২৩ (বাসস) : সুনির্দিষ্ট কোন ইভেন্ট বা ডিসিপ্লিন নয়, শুধুমাত্র খেলাধুলাকে ভালোবেসেই ময়মনসিংহ থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ট্রায়াল দিতে এসেছিলেন রাফিল আহমেদ। ওই সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। নিকটতম প্রতিবেশীরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল জিমন্যাস্টিকসে মনোযোগ দিতে। বয়স কম হওয়ায় এবং তার দক্ষতা দেখে ওই ডিসিপ্লিনের জন্যই তাকে মনোনীত করেন বিকেএসপির কর্মকর্তারা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাফিলকে। এখন তিনি জিমন্যাস্টিকসের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে পদক এনে দেয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
ইতোমধ্যেই হয়তো তিনি সেটি নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু অনভিজ্ঞতা, মানষিক চাপ এবং সামান্য ভুলের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। সিঙ্গাপুরে সদ্য সমাপ্ত এশিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় (জুনিয়র অনুর্ধ্ব-১৭) তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রাফিল। চীন, জাপান ও দক্ষিন কোরিয়ার মতো বিশ্বমানের জিমন্যাস্টদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পদক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাংলাদেশের রাফিল আহমেদ। টাইব্রেকিং নিয়মে ভল্টিং টেবিল ইভেন্টে তৃতীয় স্থান দখল করতে না পেরে পদক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন রাফিল। প্রতিযোগিতায় ভল্টিং টেবিল ইভেন্টের ফাইনালে চতুর্থ স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ১৭ বছর বয়সী এই জিমন্যাস্টকে।
১৬টি দেশের ৪২ জন প্রতিযোগির অংশগ্রহনে জুনিয়র এশিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় ভল্টিং টেবিল ইভেন্টের কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডের ফাইনালে সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষ আটে স্থান পান রাফিল। চুড়ান্ত লড়াইয়ে কাজাকিস্তানের জিমন্যাস্টের সঙ্গে যৌথ ভাবে তৃতীয় সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিশ্চিত করেন তিনি। কিন্তু টাইব্রেকিংয়ে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে তৃতীয় স্থান লাভ করে কাজাকিস্তান।
বার্তা সংস্থা বাসস’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাফিল বলেন,‘ আমি আমার সামর্থ্যের সেরাটাই দিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: এর প্রত্যাশিত ফল পাইনি। আমার ল্যান্ডিংয়ে দুই স্টেপ বেশী হয়ে গিয়েছিল বিধায় সমান পয়েন্ট পেয়েও টাইব্রেকে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে।’
তিন বছর আগে রাফিলের বাবা মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। পিতৃহীন এই জিমন্যাস্ট ও তার পরিবারটি আগলে রেখেছেন তার নানি। বর্তমানে নানির সহযোগিতা এবং পৈত্রিক যৎসামান্য সম্পত্তি থেকে আয়ের টাকা দিয়ে চলে রাফিলের পরিবার। তার বাড়ি ময়মনসিংহ হলেও নানি বাস করেন পুরনো ঢাকার নয়াবাজারে। সেখানে যাতায়াতের সুত্র ধরেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহের সৃস্টি হয় রাফিলের। তার একটাই বক্তব্য, মনোযোগ দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করলে কোন চেস্টাই বৃথা যায় না। ভালো ফলাফলের মাধ্যমে ভবিষ্যতে পরিবার ও দেশের মুখে মুখে হাসি ফুটাতে চান তিনি।
জিমন্যান্টিকস ইভেন্টটি বাংলাদেশে খুব বেশি প্রচলিত না থাকলেও ফেডারেশন সভাপতির আগ্রহ ও সার্বিক তত্বাবধানে খেলাটি যেন বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। সিঙ্গাপুর সফরে যাওয়া বাংলাদেশ যুব দলের ছয় সদস্যের মধ্যে পাঁচ জনেরই বাড়ি পার্বত্য অঞ্চলে। একমাত্র রাফিলের বাড়িই সমতল ভুমিতে। সিঙ্গাপুর সফরে যাওয়ার আগে ব্যতিক্রমী এক আয়োজন করে ফেডারেশন। সেখানে প্রতিযোগিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। আয়োজন করা হয় নিজেদের মধ্যে টুর্নামেন্ট। টুর্নামেন্টে কেবল বিজয়ী নয়, সকলের হাতে অর্থ পুরস্কার দেন ফেডারেশন সভাপতি। এমনকি প্রতিযোগিদের পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় আসা যাওয়া, থাকা খাওয়া সকল খরচ বহন করে ফেডারেশন। খেলোয়াড়দের অর্থ পুরস্কার তুলে দেয়া হয় পরিবারের হাতে। যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের সন্তানটি কোথায় আছে, কেমন আছে। যে কারণে প্রতিযোগি ও তাদের পরিবারের সকলেই খুশি। দলের জন্য বিদেশী কোচের পিছনে প্রতি মাসে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করছে ফেডারেশন। কোচের তত্বাবধানে বাংলাদেশের জিমন্যাস্টরা অনেক উন্নতি করছে। যা থেকে আশাবাদী জিমন্যাস্টরা তথা ফেডারেশন। ভাল করার বিষয়ে আত্মবিশ^াসী হয়ে উঠছেন জিমন্যাস্টরা।
রাফিল বলেন,‘ এবারের সাফল্যে আমি আত্মবিশ্বাসী। আশা করি আগামীতে আরো সাফল্য পাব। সিনিয়র পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরো কঠিন হবে। তবে আমার মনে হয় এতে কোন সমস্যা হবে না। আরেকটু মনোযোগী হতে হবে এবং পরিশ্রম আরো একটু বাড়াতে হবে। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে যে ভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে সেটি অব্যাহত থাকলে আশা করি আরো ভালো করতে পারব। ’
জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সভাপতি শেখ বশির আহমেদ বলেন,‘ এরকম একটি বড় মঞ্চে আমাদের ছেলেরা কখনো পারফর্ম করেনি। যে পরিবেশ থেকে তারা গেছে এবং সেখানে পারফর্ম করেছে তা দৃঢ় মানষিকতার জিমন্যাস্টদের জন্যও কঠিন ব্যাপার। প্রতিপক্ষ চীন, জাপান বা কোরিয়ানরা যে প্লাটফর্মে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অভ্যস্ত তাদের সঙ্গে আমাদের পরিবেশের তারতম্য আকাশ পাতাল।’
তিনি বলেন,‘ (সিঙ্গাপুরে)আমাদের প্রত্যাশা আরো বেশী ছিল, রাফিল যে জায়াগায় ল্যান্ডিং করলে স্বর্নপদক পেতেন সেটি করতে না পারায় আমাদের চতুর্থ হতে হয়েছে। তারপরও আমরা সন্তুস্ট। আরেকটি বছর যদি আমরা এভাবে অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে হয়তো বড় অর্জনের জন্য আর বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না।’
জিমন্যাস্টিক ফেডারেশনের এই শীর্ষকর্তা বলেন,‘ আমরা যদি আরো অন্তত এক সপ্তাহ আগে দলকে সেখানে পাঠাতে পারতাম, তাহলে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়াটা তাদের জন্য আরো সহজ হতো। কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। তখন হয়তো দলগত ভাবে আমরা আরো ভালো করতে পারতাম। এর আগে এত বড় ইভেন্টে আমরা অংশগ্রহন করিনি। সুতরাং এখান থেকে আমরাও অনেক কিছু শিখেছি, আশা করি আগামীতে আমরা আরো ভালো করতে পারব। এই ছেলেদের নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী।’