শিরোনাম
॥ আরিফ রিজভী ॥
ফেনী, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ‘এবার হাসিনা সরকারের পতন না হলে আর কখনোই হবে না, প্রয়োজনে তোমাকেও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আম্মু তুমিও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থেকো’-গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে যাওয়ার সময় এটিই ছিলো শহিদ সাইদুল ইসলাম শাহীর মাকে বলা শেষ কথা। এদিন আন্দোলন চলাকালে মহিপাল সার্কিট হাউজ রোডে গুলিবিদ্ধ হন সাইদুল ইসলাম শাহী (২১)। স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যান তিনি।
জেলার সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড নিবাসী রফিকুল ইসলাম এবং রেহানা বেগম দম্পতির পুত্র সাইদুল ইসলাম শাহী। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। শাহী ২০২১ সালে ফাজিলপুর ডব্লিউ-বি কাদরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এ বছর তার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিলো।
সাইদুলের মা রেহানা বেগম বাসসকে বলেন, আন্দোলন শুরুর পর থেকেই সাইদ প্রতিদিন ফেনী গিয়ে আন্দোলনে অংশ নিত। আমাকে বলেই যেত। আমিও যেতে না করিনি কখনও। তবে আমার অভাবের সংসার, তার বাবা লেগুনা গাড়ি চালায়। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হওয়াতে তাকে ঠিকভাবে টাকা দিতে পারিনি কোনদিন। ৪ আগস্ট ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ২৫ টাকা চেয়েছিল সাইদুল। বলছিল তার কাছে ২৫ টাকা আছে, আরও ২৫ টাকা হলে ফেনী গিয়ে ফিরে আসতে পারবে।
সেদিন আন্দোলন থেকে লাশ হয়ে ফেরেন সাইদুল। দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে শহিদ হয়েছেন তিনি, এটাই পুত্রশোকে কাতর মা-বাবার একমাত্র সান্তনা এখন।
রেহানা বেগম বলেন, আমার তিন ছেলে। সাইদুল দ্বিতীয়। ধারদেনা করে তাদের পড়াশোনা করিয়েছি। অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তা পূরণ হতে দেয়নি। আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করল। আমি আমার পুত্রের হত্যাকারীদের বিচার চাই।
সাইদুলের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানাব। কিন্তু আমার ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে, আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গাড়ি চালিয়ে আমি সংসার চালাতাম, বড় ছেলে মাত্র কাজ শুরু করেছিল। আমার ৩ সন্তানের মধ্যে সে বেশি মেধাবী ছিল। তারা আমার ছেলেকে হত্যা করল, মামলা করেছি ইতোমধ্যে। আমি খুনিদের বিচার চাই। নিহত সাইদুলের বড় ভাই সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাই ছিল আমাদের সবার থেকে আলাদা। কথাবার্তা কম বলত, মনের মধ্যে দেশের জন্য ভালোবাসা ছিল। রাজনৈতিকভাবে সে কখনও সম্পৃক্ত ছিল না। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। তবে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করল। তার গায়ে ৪ টি গুলি লেগেছিল।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবারটি। সহিদুল বলেন, বন্যায় আমাদের সব শেষ। এবারের বন্যায় ঘরের কিছুই বাঁচাতে পারিনি। ঘরের অনেক আসবাবপত্র ফেলে দিতে হয়েছে। মা-বাবাকে নিয়ে দুইদিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। পরে আমি তাদের বারৈয়ারহাট নিয়ে যাই। পানি কমার পর ফিরে এসে দেখি, ঘরের অবস্থা খুবই নাজুক।
সাইদুলের বাল্যকালের বন্ধু নিশাদুল ইসলাম সৌরভ বলেন, তার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল ৪ আগস্ট সকালে। দেশের প্রতি সাইদুলের অনেক ভালোবাসা ছিল। দেশের নানা অন্যায় দুর্নীতি নিয়ে সে সবসময় সরব ছিল। খেলাধুলায় ছিল তার প্রবল আগ্রহ। চট্টগ্রামে বিভাগীয় পর্যায়েও সে ফুটবল খেলেছে। তার স্বপ্ন ছিল তার পরিবারের অভাব অনটন দূর করে মায়ের কষ্ট লাঘব করা।
সাইদুলের প্রতিবেশিরা জানান, সাইদুল তাদের গর্ব। তার বাবার আর্থিক অবস্থা এত ভালো নয়। সে লেখাপড়া করছিল যাতে পরিবারের হাল ধরতে পারে। কিন্তু তার আগেই ঘাতকরা তার স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে।
সাইদুলের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, সাইদুলের মৃত্যুর পর ছাত্ররা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর্থিকভাবে ও মানসিকভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই খোঁজ খবর নিয়েছে। কিন্তু সাইদুলের দুইভাইকে মানুষ করার জন্যে দরকার যথাযথ আর্থিক সহায়তা।
সাইদুলের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে, কিন্তু তার প্রাণের স্বদেশে সাইদুলের দুইভাই যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে জন্যে সহায়তার হাত বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।