শিরোনাম
চাঁদপুর, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বাসস): বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার এক দফার আন্দোলনের শেষের দিকে কর্মসূচিতে যোগ দেয় সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র সামিউ আমান নূর। বিজয়ের কথা বাবাকে ফোন করে জানালেও শেষ পর্যন্ত নতুন স্বাধীনতার সুফল দেখে যেতে পারেননি।
জাতীয় পতাকা হাতে গত ৫ আগস্ট দুপুরে বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সামিউ(১৩)। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে হত্যার বর্ণনা দেন বাবা মো. আমান উল্লাহ।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পশ্চিম সহদেবপুর ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামের লাল ডাক্তার বাড়ি হচ্ছে সামিউ আমান নূরের পৈত্রিক বাড়ী। কিন্তু পরিবারের সাথে সামিউ নূর টঙ্গিতে থাকতেন। সেখানেই স্থানীয় সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যা নিকতনে সপ্তম শ্রেণীর ‘ঘ’ শাখায় অধ্যয়নরত ছিলেন।
সামিউ আমান নূর টঙ্গিতে থাকলেও বিদ্যালয় বন্ধ হলে পরিবারের সদস্যদের সাথে চলে আসতেন নিজ গ্রামে। এখানে এসে চাচাদের বাড়িতে বেড়াতেন। স্বজনদের সাথে তার আচার আচরণ ছিল খুবই মধুর। তার মৃত্যুর খবর আসার পর থেকেই পরিবারের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার কথা বলতে গিয়ে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কারণ সামিউ আমান উল্লাহর একমাত্র ছেলে। দুই মেয়ের পর জন্ম নেয় সামিউ। তাকে নিয়ে নানা স্বপ্ন ছিলো পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন স্বপ্নই রয়ে গেলো।
সামিউ নূরের বাবা আমান উল্লাহ এক সময় প্রবাসে ছিলেন। এখন ঢাকার টঙ্গী জেলার ১৯৫ কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের আরিচপুর নিজ বাড়িতে থাকেন। তবে সময় পেলে চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে। গত ৫ আগস্টও ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুপুরে সামিউ বাবাকে ফোন দিয়ে বলেন ‘বাবা স্বৈরাচারি হাসিনা পালিয়েছে’। এরপর আর কথা হয়নি ছেলের সাথে।
সম্প্রতি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাঘমারা গ্রামে সামিউ আমান নূরের পৈত্রিক বাড়িতে কথা হয় বাবা-মা ও স্বজনদের সাথে। তাকে দাফন করা হয় বাড়ির পাশেই। সেখানে তার কবর সংরক্ষণ করার কাজ চলছে। কিশোর সামিউ আমান নূরের মৃত্যুতে এখনো বাড়িতে আসছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। অনেকে বাবা-মাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন।
সামিউ নূরের চাচি শরীফা বেগম বলেন, বয়স কম হলেও নূর অনেক লম্বা হয়েছিল। টঙ্গি থেকে আসলেই আমাদের বাড়িতে থাকত। আমাকে জড়িয়ে ধরতো। সামিউ খুবই মায়াবি একটি ছেলে ছিল। তার এমন মৃত্যুতে আমরা খুবই শোকাহত এবং মর্মাহত। তার সম্পর্কে বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ওই ছিল পরিবারের একমাত্র ছেলে। তাদের অনেক স্¦প্ন ছিলো ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
সামিউ’র বাবা আমান উল্লাহ বলেন, ছেলে আমাদেরকে না জানিয়ে আন্দোলনে যেত। তবে ৫ আগস্ট আমি চাঁদপুরে ছিলাম। ওইদিন দুপুরে আমাকে জানালো বাবা ‘হাসিনা পালাইছে’। আমি তখন বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। এরই মধ্যে আমার ছেলে বিজয় মিছিলে চলে যায়। ঠিক আছরের নামাজের সময় আমার কাছে কল আসে আপনার ছেলে গুলি খেয়েছে। আমি জানলাম ছেলে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মিছিলে গিয়েছিল। যখন উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এর সামনে আসে তখনই সে গুলি খায়। তার সাথের অন্য ছেলেরা তাকে ভ্যানগাড়ী করে টঙ্গি মেডিকেলে নিয়ে আসে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতাল থেকে বলা হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
তিনি বলেন, ছেলেকে বাঁচানোর জন্য আমার স্ত্রীসহ লোকজন ওই হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রওয়ানা হলেও উত্তরা পর্যন্ত এসে আর এগুতে পারেনি। কারণ বিজয় মিছিল নিয়ে সব বয়সী লোকজন তখন রাস্তায়। মেডিকেলে যাওয়ার মত কোন পরিস্থিতি ছিলো না। তখন তারা উত্তরায় কয়েকটি মেডিকেলে গেল। ওইসব হাসপাতালে সব গুলিবিদ্ধ রোগি। কারো চোখে, কারো মাথায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লেগেছে। এরপর ছেলেকে উত্তরা বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে কয়েক ব্যাগ রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তাকে আর রক্ত দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর নেয়া হয় উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে। সেখানে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। কিছু সময় পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সামিউ আমান নূরের বড় বোন আফরিন আমান বলেন, নূর আমাদের সবমসময় বলতো বড় হয়ে ও অনেক নামি-দামি হবে। সবাই ওকে এক নামে চিনবে। আমাদের সবাইকেও ওর নামেই চিনবে। বাস্তবে এখন তাই হলো। এখন আমাকেও সবাই নূরের বোন হিসেবে চেনে।
আফরিন বলেন, নূরের আরও একটা বড় স্বপ্ন ছিলো- দেশের বাহিরে অন্য কোন বড়দেশের নাগরিক হবে। আর দৈহিকভাবে অনেক লম্বা হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। ১৩ বছর বয়সেই ও অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলো। ও এতো লম্বা না হলে হয়তো ওর মাথায় গুলিটা লাগতো না। আমাদের নূর এখানে আমাদের সাথেই থাকতো। নূর ছয় বছর বয়স থেকেই সবগুলো রোজা রাখতো। বাবার সাথে মসজিদে গিয়ে পুরো তারাবির নামাজ আদায় করতো। আর ওর হাসি, ওর হাসি এখনো ওর বন্ধুবান্ধব ওর এলাকার কেউ এখনো ভুলতে পারে না। তার স্কুলের বন্ধুরাও তার জন্য কাঁদছে। কিছু মানুষের মৃত্যু যে পুরো পৃথিবীকে এবাবে শূন্য বানিয়ে দিতে পারে সেটা আমার ভাই নূর আমাদের দেখিয়ে দিলো।
সামিউ’র মা শাহনুর আমান প্রথমে কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত এবং অসুস্থ। কথা বলতে চাইলেও মুখে আটকে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। ছেলের শেষ সময়ের কথাগুলো বলার জন্য অনুরোধ করা হয়। তিনি বলেন, এইটুকুন ছোট ছেলে। কি অপরাধ ছিলো তার। পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় মিছিলে গিয়েছিলো। তাকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হলো।
তিনি বলেন, আফরিন ও আফসানা আমার বড় দুই মেয়ে। তাদের পরে আমার একটি ছেলে বহু আকাক্সক্ষার। আমি সব সময় আল্লাহর কাছে চাইতাম আমার যেন একটি ছেলে সন্তান হয়। আমার নামাজের সময় আমার মেয়েরাও আমার সাথে মোনাজাতে হাত তুলে বলতো আমাদের যেন একটি ভাই হয়। আল্লাহ আমাদের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। তার নাম রাখলাম সামিউ আমান নূর। আমার ছেলে নূরের মতই আলোকিত হয়েছে। বাইরে থেকে আসলেই আমাকে জড়িয়ে ধুরে চুমু খেত। বলতো মা তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা।
ছোট বেলা থেকেই মাকে নূর বলতো আমি অনেক নাম করা হবো। বোনদেরকে বলতো তোদেরকে আমার নামে সকলে চিনবে। তার স্বপ্ন ছিলো অনেক বড় দেশে যাবে, বড় দেশের নাগরিক হবে। যে কারণে সে ইংরেজি ভাষার চর্চা করতো। মা শাহনুর বলেন, আমার ভাই বিদেশে থাকে। আমাদের স্বপ্ন ছিলো সে এইচএসসি পাশ করলে তাকে বিদেশে পাঠানো। এসব শুধইু এখন স্বপ্ন!