শিরোনাম
॥ রুপোকুর রহমান ॥
সাভার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪ (বাসস): বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ শুভ শীলের পরিবারে এখন শোকের মাতম। একদিকে সন্তান হারানোর বেদনা, অন্যদিকে ঋণের বোঝা। কোনদিক সামলাবে পরিবার? সন্তানের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সাড়ে চার লাখ টাকা সুদে ঋণ নিয়েছেন হতদরিদ্র বিকাশ শীল । তিনি এখন এই ঋণ এখন কিভাবে শোধ করবেন?
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন শুভ শীল(২৫)। আহত অবস্থায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই তিনি মারা যান।
শহিদ শুভ শীল সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানাধীন জিরানী বাজার এলাকার বাসিন্দা বিকাশ শীল (৫৫) ও সাধনা শীল (৪৫) দম্পতির পুত্র। দুই ভাইয়ের মধ্যে শুভ ছোট। শুভ শীল সাভারের কেসি গার্মেন্টস এ চাকরি করতেন। বড় ভাই সোহাগ শীল (২৭) স্থানীয় এ্যাপারেলস গার্মেন্টস-এ চাকরি করেন। বিকাশ শীল পেশায় নরসুন্দর।
শুভ শীলের মা সাধনা শীল বাসসকে জানান, শুভ শীল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। অনেক কাছ থেকে গুলি করায় গুলিটি তার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আহত অবস্থায় শুভ শীল ৫টা ৫৫মিনিটে মায়ের মোবাইল ফোনে ফোন করলে তার বড় ভাই সোহাগ শীল ফোন রিসিভ করে। গুলিবিদ্ধ শুভ শীল ফোনে ভাইকে বলেন, ‘ভাই ওরা আমাকে গুলি করেছে, আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি। আমিতো শেষ। আমি মনে হয় আর বাচঁবো না।’ গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে প্রথমে শুভ শীলের মামা বাসুদেব বিশ^াস ও পরে তার মা ও ভাই এবং রাত দশটার দিকে বাবা হাসপাতালে আসেন।
শুভ শীলের মা সাধনা শীল তার ছেলের মৃত্যুর জন্য চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ করে বলেন, আমার ভাই বাসুদেব সন্ধ্যা সাতটায় হাসপাতালে পৌঁছে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের দ্রুত চিকিৎসা শুরুর তাগিদ দিলেও তারা কালক্ষেপণ করতে থাকে। আমরা পৌনে ৮টায় হাসপাতালে পৌঁছে দেখি শুভ’র চিকিৎসা তখনো শুরু হয়নি। এসময় চিকিৎসার তাগিদ দিলে চিকিৎসকরা জানান প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই অনেক রক্ত লাগবে। তখন আমি ও আমার বড় ছেলের রক্তের গ্রুপ একই জানালেও চিকিৎসকরা এই রক্ত দেয়া যাবে না বলে আরো সময় নষ্ট করেন। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে হাসপাতালে নেয়া হলেও রাত ১০টা পর্যন্ত শুভ শীলের কোন চিকিৎসা শুরু হয়নি।’
সাধনা আরো জানান, এসময় শুভ শীল তার মা’র কাছে পানি চান। কিন্তু চিকিৎসকদের নিষেধ থাকায় তা দিতে পারেন নি। শুভ শীল এসময় মায়ের কাছে মাফ চান। একপর্যায়ে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয় শুভ শীলের পরিবারের সদস্যদের। পরে বিকাশ শীল ও তার পরিবারের সদস্যদের পীড়াপীড়িতে রাত ১০টার পর চিকিৎসা শুরু হয়। এসময় চিকিৎসকরা জানান, তার পেট দিয়ে গুলি ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এতে তার নাড়ী ছিঁড়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। টানা ৪দিন সেখানেই চলে শুভ শীলের চিকিৎসা। পুত্রের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে স্থানীয়দের কাছ থেকে সুদে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা ঋণ নেয় তার পরিবার। যার মধ্যে ঔষধের বিলই পরিশোধ করতে হয় ১ লাখ টকার উপরে। আর বাকি টাকা ব্যয় হয় হাসপাতালের খরচ মেটাতে। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২৩ তারিখ ভোরবেলা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শুভ শীল। সাধনা শীল পরিবারের এমন অবস্থায় প্রশাসনের সহযোগিতা ও পুত্র হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।
শহিদ শুভ শীলের মামা বাসুদেব বিশ^াস বাসস’কে বলেন, পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই আশুলিয়ার জিরানীবাজার এলাকা থেকে আমাদের বাড়ী ধামরাই উপজেলার চৌটাইল গ্রামে বেড়াতে আসে শুভ শীল। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনে অনেকে হতাহত হওয়ায় আমি ওকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতাম না। ২০ জুলাই দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমি বাড়ির বাইরে যাই। এসময় শুভকে আমি বাইরে বের হতে নিষেধ করি। কিন্তু আমি বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই দুপুর ৩টার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাভার বাসষ্ট্যান্ডের দিকে যায়। এরপর দুপুর সাড়ে ৫টার দিকে ও গুলিবিদ্ধ হয়।
আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের বরাত দিয়ে বাসুদেব বিশ্বাস জানান, গোলাগুলি দেখে শুভ একটি দোকানের ভেতরে গিয়ে পালালেও খুব কাছে গিয়ে ওকে গুলি করা হয়। সে সময় গুলিটি ওর পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ওকে সবাই মিলে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে সাড়ে ৬টার দিকে। সেখানে দীর্ঘক্ষণ ওকে ফেলে রাখা হয়। অনেক তাগিদ দেওয়া হলে রাত ১০টার পর ওর চিকিৎসা শুরু করে চিকিৎসকরা।
তিনি ভাগ্নের জন্য সকলের কাছে দোয়া চেয়ে সমাজের বিত্তবানসহ সংশ্লিষ্টদের ওর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
শহীদ শুভ শীলের বড় ভাই সোহাগ শীল মুঠোফোনে বাসস’কে বলেন, ভাই হারানোর বেদনা বলে বোঝানোর নয়। অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল শুভ। পরিবারের কথা অনেক চিন্তা করতো। আমাদের বাবা পেশায় নাপিত। অস্বচ্ছলতার সংসারে পরিবারের হাল ধরতে শুভও কাজ নেয় পোশাক কারখানায়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফোনে ওর সাথে আমারই কথা হয়। তখন ও আমাকে বলে, ‘ভাই আমাকে ওরা গুলি করেছে, আমি মনে হয় আর বাচাঁবো না। আমাকে তোরা মাফ করে দিস।’ তখন আমি ওকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বললে ও বলে আমি হাসপাতালে যাওয়ার অবস্থায় নেই, আমার অবস্থা খুব খারাপ। এরপর ফোন রেখে দেয়। পরে স্থানীয়রা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই ও মারা যায়। ভাইয়ের অভাব পূরণ হবার নয় উল্লেখ করে সোহাগ শীল আরও বলেন, ছোট ভাইটি’র চিকিৎসা করাতে গিয়ে আজ আমাদেরকে পথে বসতে হচ্ছে। কয়েক লাখ টাকা দেনা হয়েছে। আমাদের এখন কিভাবে চলবে তাও বুঝতে পারছি না।
শহীদ শুভ শীলের বাবা বিকাশ শীল মুঠোফোনে বাসস’কে বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ী ঝিনাইদহ জেলার ঝিনাইদহ সদর থানাধীন মনোরিয়া গ্রামে। সাভারের আশুলিয়ায় এসেছি ২০ বছরেরও বেশী সময়। আমার দু’টি ছেলে সন্তান। শুভ শীল ছিল ছোট। ওর গুলিবিদ্ধের খবরে ওর মা-ভাই আগে চলে গেলেও দেরিতে খবর পাওয়ায় আমি ১০টার দিকে হাসাপাতালে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে শুভকে পড়ে থাকতে দেখি। তখন ও আমার কাছে মাফ চেয়ে বলে বাবা আমি মনে হয় আর বাচাঁবো না, আমাকে তোমরা মাফ করে দিও। একথা শুনে আমি নিস্তব্ধ হয়ে যাই। চিকিৎসকদের বলি দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে। তখন রাত ১০টার পর শুভ’র চিকিৎসা শুরু করে চিকিৎসকরা। সেখানে ডাক্তাররা একের পর এক ঔষধ আনতে বলে। অভাব-অনটনের সংসার আমাদের। জমাকড়ি বলতে কিছুই নেই আমাদের। কিন্তু ছেলের চিকিৎসার কথা ভেবে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নেই। এভাবে নিতে নিতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ছেলের ঔষধ আর চিকিৎসার খরচ দেই। তারপরও ছেলেকে বাচাঁতে পারলাম না। আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বিধাতার কাছে চলে গেছে সে।
বিকাশ শীল কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ছেলে মারা যাওয়ার আজ প্রায় ৩ মাস হতে চললো, এখনো পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোন ধরনের সাহায্য পাইনি। শুনেছি অনেকেই অনেক ধরনের সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু আমাদের সাহায্যে এখনো কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, এমনিতেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আছি। ধীরে ধীরে ঋণের দায়ও বাড়ছে। এমন অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপনের কথা উল্লেখ করে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।