বাসস
  ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:০৮
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:০৮

নিজের চিকিৎসা, বাবার অসুস্থতা, ঋণ পরিশোধ, কী করবে গুলিবিদ্ধ ওমর?

॥ মোঃ মামুন ইসলাম ॥
রংপুর, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : ভ্যানগাড়ি চালক ওমর ফারুক  বুলেটবিদ্ধ হয়ে বিছানায়। অসুস্থ বাবা। এগারো সদস্যের সংসারের খরচ। আহত ওমর এখন বড়ো অসহায়। কি করবে তার পরিবার? 
অথচ তিন মাস আগেও ওমর পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হিসাবে কঠোর পরিশ্রম করছিলেন। এখন তিনি চরম আর্থিক সংকটের কবলে। 
ওমর বলেন, ‘বিগত ১৮ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের একটি গুলি আমার নাভির নিচ দিয়ে ঢুকে পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। একইসঙ্গে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় আমার জীবনের সকল স্বপ্ন।’ 
ঘটনার দিনই রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (আরপিএমসিএইচ) ওমরের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে তিনি ফিরে আসেন।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩১ নং ওয়ার্ডের শেখপাড়া গ্রামের চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ওমর ফারুক(৩৫) একই গ্রামে তার শ্বশুর বাড়ীতে স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করেন। 
এই ভয়ংকর ট্র্যাজেডি তার জীবনে আঘাত হানার আগে, ওমর তার ভ্যানগাড়িতে করে প্রতিদিন গ্রামাঞ্চল থেকে রংপুর শহরে এনে নেপিয়ার ঘাস বিক্রি করে তার ১১ জনের ভরণ পোষণ চালিয়ে আসছিলেন। 
তার বাড়িতে সম্প্রতি বাসস’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের সময় ওমর হতাশা, বেদনা ও দুঃখের সাথে সেদিন তার সাথে কী ঘটেছিল এবং পরবর্তী কালে তার জীবনে নেমে আসা দুর্দশা বর্ণনা করেছিলেন। ওমর এখন বিছানায় কঠিন দিন পার করছেন। কারণ জটিল অস্ত্রোপচার এবং পরবর্তী অস্ত্রোপচার না হওয়া পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে মলত্যাগ করার জন্য তার শরীরে একটি কোলোস্টোমি ব্যাগ বাহ্যিকভাবে সংযুক্ত রয়েছে। ওমরের শরীরে এখন প্রচ- ব্যথা। সুস্থতার জন্যে চার মাস পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার শরীরে আরেকটি বড় অস্ত্রোপচার করা হবে। সুস্থ হলে ওমর  আবারো পরিবার বাঁচাতে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এই আশা।
ওমর তার বাবা খলিলুর রহমান (৬০), স্ত্রী জোহরা বেগম (২৭), ছেলে জুনায়েদ হাসান (সাড়ে সাত বছর এবং মেয়ে ফাহমিদাকে (আড়াই বছর) সাথে নিয়ে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকেন। 
দিনমজুর শ্বশুর জয়দুল ইসলাম (৫৫) তার ছেলে রাসেল (২২) ও মেয়ে পারভিন বেগম (৩৬) ও পারভিনের দুই সন্তান মিলে এই যৌথ পরিবার। 
ওমর বলেন, ‘আগে আমার দিনমজুর বাবা ১১ জনের এই সংসার চালাতে কিছুটা সহযোগিতা করতে পারতেন। কিন্তু  বয়স বাড়ায়, কঠোর শারীরিক পরিশ্রম এবং পায়ের হাড় ক্ষয়ের কারণে আমার বাবা আর হাঁটতে ও কাজ করতে পারেন না।’ 
বাবাকে ওমর অনেক ভালোবাসেন। বাবার যথাযথ চিকিৎসার জন্য সামান্য করে অর্থ সঞ্চয় শুরু করেছিলেন। 
কিন্তু বির্ধি বাম। ওমরের আকাঙক্ষা মুখ থুবড়ে পড়েছে। অশ্রুভেজা কন্ঠে ওমর বলেন,  ‘জীবনের এই ট্র্যাজেডি আমার  আকাক্সক্ষাকে ভেঙে দিয়েছে। বাবার চিকিৎসা কি করব, পরিবারের খরচ চালানোই এখন দায়।’ 
ওমর আরো বলেন, ‘আমার দিনমজুর শ্বশুরও এখন কর্মহীন। ফসলের মাঠে কোনো কাজ না থাকায় তিনি উপার্জন করতে পারছেন না।’ 
এ অবস্থায় কি করে সবার মুখে খাবার জুটবে এ চিন্তায় দিশেহারা ওমর। এর ওপর রয়েছে অস্ত্রোপচারের খরচ। কি হবে, কি করবে এখন ওমর?
ওমর বলেন, গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার পর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চরমে পৌঁছায়। তবু পেটের দায়ে ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো ভ্যানগাড়ি নিয়ে আমি বের হই। 
তিনি বলেন,  বিকেলে নগরীর মডার্ন মোড় এলাকা সংলগ্ন ফাতেমা কোল্ড স্টোরেজের কাছে মেরামতের দোকানে ভ্যানগাড়ি সারাতে যাই। এ সময়ে আমি পুলিশের গুলিতে আহত হই।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওমর অজ্ঞান হয়ে পড়েন। চেতনা ফিরে পাওয়ার পর তিনি নিজেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে দেখতে পান।
এসময় ওমর আরও অনেক আহত ব্যক্তিকে দেখেন, যারা পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘পরে, আমি জানতে পারি যে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুল বাছেদ, অন্যান্য ডাক্তার, ছাত্র, নার্স এবং কর্মচারীরা আমার জীবন বাঁচানোর জন্য জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন।’ 
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১০ আগস্ট রংপুর হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে ওমরের সাথে তিনি কথা বলেন। সে সাক্ষাতের মধুর মুহূর্ত স্মরণ করে ওমর বলেন, তার এখনও মনে আছে যখন তিনি ওই হাসপাতালে এসে তার সাথে দেখা ও কথা বলেন। ডাঃ মোঃ আব্দুল বাছেদের সাথে কথা বলে তার স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর করেন। 
তিনি বলেন, ‘ডাঃ মোঃ আব্দুল বাছেদ, যিনি ১৮ জুলাই আমার অস্ত্রোপচার করেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমার অবস্থা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তখন আমি এই বিশ্বাস নিয়ে সাহস ফিরে পাচ্ছিলাম যে অন্তর্বতীকালীন সরকার আমার এবং অন্যান্য সকল শহিদ ও আহতদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’ ওমর বলেন, ‘অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেয়ার সময় ডাঃ মোঃ আব্দুল বাছেদ আমার সার্বিক অবস্থার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন।’ 
তবু ওমর তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা এখনও পাননি। তিনি দুঃখের সাথে বলেন, তার চিকিৎসার জন্য তাকে তার জায়গা জমি সবকিছু বিক্রি করতে হয়েছে এবং অনেকের কাছে তার স্ত্রীকে অর্থ ধার করতে হয়েছে। ট্র্যাজেডির তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনও কোনো সরকারি সাহায্য পাননি। অন্যান্য সাহায্য যেটুকু পেয়েছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য।
বাসস’র সাথে আলাপকালে, রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুল বাছেদ ওমরের স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং পরবর্তী অস্ত্রোপচার সম্পর্কে বর্ণনা করেন। 
তিনি বলেন, আর যদি মাত্র এক ঘণ্টা পর ওমরকে হাসপাতালে আনা হত, তাহলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তাকে বাঁচানো যেতো না। 
আগামী চারমাস পর ওমরের শরীরে আবারো অস্ত্রোপচার করা হবে বলে তিনি জানান। আর এ অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে ওমর সুস্থ হয়ে উঠবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
নিজ বাড়িতে বাসস’র সাথে আলাপকালে ওমরের স্ত্রী জোহরা বেগম জানান, তার শ্বশুর, স্বামী, দুই সন্তান এবং তার নিজের বাবা, মা, এক ভাই ও এক বোন পারভীন বেগম ও এই বোনের দুই সন্তানসহ সহ তাদের ১১ জনের একটি যৌথ পরিবার রয়েছে। 
তিনি বলেন, আমরা মূলত আমার স্বামীর আয়ের ওপর টিকে ছিলাম। কারণ তিনি রংপুর শহরে তার ভ্যানগাড়ীতে নিয়ে নেপিয়ার ঘাস বিক্রি করে গড়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা উপার্জন করতেন।’ 
তিনি বলেন, আর্থিক অসুবিধা সত্ত্বেও, আমরা ১৮ জুলাই পর্যন্ত ভালই ছিলাম। আমার ছেলে জুনায়েদ হাসান স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র এবং মেয়ে ফাহমিদার বয়স মাত্র আড়াই বছর। 
তিনি জানান, কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে তার স্বামী গুলিবিদ্ধ হন। বুলেটটি নাভির নিচ দিয়ে ঢুকে পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তার স্বামীকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। ইতোমধ্যে একটি বড় অস্ত্রোপচার হয়েছে। আমরা হাসপাতালের ডাক্তার, ছাত্র, নার্স এবং স্টাফদের সহায়তা ছাড়াও  তার চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করেছি।
কয়েক মাস পর আবারও অস্ত্রোপচার করাতে হবে। তিনি জানেন না কিভাবে তার পরিবার টিকে থাকবে। তিনি ইতোমধ্যেই অনেক বেশি ঋণে জর্জরিত। 
তিনি তার স্বামীর চিকিৎসার জন্যে সহায়তা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। 
তবে এপর্যন্ত চিকিৎসা ব্যয় বাবদ জামায়াতে ইসলামী ১০ হাজার টাকা, সাজিদা ফাউন্ডেশন ১৫ হাজার টাকা, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ১০ হাজার টাকা, মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থীকে ১০ হাজার টাকা এবং একজন ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান খান ৫ হাজার টাকা দিয়েছে বলে জানান তিনি। এ সাহায্য খুবই অপ্রতুল বলে তিনি উল্লেখ করেন। 
জোহরা বেগম বলেন,‘আমার স্বামীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে জরুরি প্রয়োজনে আমাকে মাত্র ৩০ হাজার টাকায় ভ্যান গাড়ীটি এবং ৪৪ হাজার টাকায় গরু বিক্রি করতে হয়েছে। এছাড়াও, আমাদের অন্যদের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার করতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন অর্থাভাবে নিজেদের খাবারেরও ঠিকমত ব্যবস্থা করতে পারছিনা। এজন্য ওমর উদ্বিগ্ন যে আমরা ইতিমধ্যেই ব্র্যাক থেকেও যে বিপুল ঋণ নিয়েছি, তা কিভাবে পরিশোধ করব এবং দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের খরচ কোথা থেকে আসবে? 
তিনি ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ এবং অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রতি তাদের শোচনীয় অবস্থা এবং সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাসের কথা বিবেচনা করে তাদের ঋণ মওকুফ করার আহ্বান জানান। এছাড়াও জোহরা তার স্বামীর সুস্থতার পরে তার জন্য একটি নতুন ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করারও অনুরোধ জানান।
এদিকে ওমরের চিন্তার কোন শেষ নেই। কেবল আর্থিক দুশ্চিন্তাই নয়, আবারো অস্ত্রোপচারের পর তিনি কতোটুকু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন, সংসারের হাল ধরতে পারবেন তা নিয়ে  তার উদ্বেগ যেন ফুরোয় না। কেবল নিজের নয়, বাবার চিকিৎসা নিয়েও ওমরের আকাক্সক্ষা কবে পূরণ হবে এ অপেক্ষায় দিন গুনছেন ওমর। 
এ জন্যে দরকার পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো। সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের সহায়তাই পারে ওমরের জীবন ও পরিবারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে।