শিরোনাম
প্রতিবেদন : মুহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
গাজীপুর, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কারফিউর কারণে রোজগার বন্ধ। অসুস্থ বাবা বিছানায়। ঘরে পরের দিনের বাজার করার টাকাও নেই। এ অবস্থায় গত ২০ জুলাই বিকালে অটো চালক মো. তুহিন মিয়া বাজার করার টাকা জোগাড় করতে অটোর খ্যাপ নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তার আর বাজারের টাকা রোজগার করা হলোনা। উল্টো রক্তাক্ত লাশ হয়ে ঘরে ফিরলেন তুহিন মিয়া (১৮)।
শহিদ তুহিন মিয়ার মা তাসলিমা বেগম (৩২) বাসসকে বলেন, ‘অভাবের সংসারে আমার তুহিন সবাইকে আগলে রেখেছিলো। তার বাবা অসুস্থ থাকায় সে অটো চালাতো। ২০ জুলাই বিকেল ৫টায় আমার ছেলে ঘর থেকে বের হয়েছিলো। ছেলে বলেছিলো মা কালকে বাজার করার টাকাটা রোজগার হলেই চলে আসবো। আমার ছেলেতো আর ফিরলোনা। আমার ছেলের কি অপরাধ ছিলো? কেন আমার ছেলেরে গুলি করে হত্যা করলো? আমার ছেলে ঘরে আসলেই মা বলে ডাক দিতো। বিপদ আপদে আমারে সান্ত্বনা দিতো। বলতো চিন্তা করোনা মা আমিতো আছি। ঘরের কেউ অসুস্থ হলে দৌড় দিয়া ওষুধ নিয়া আসতো।
এখন আমারে সান্ত্বনা দেবে কে? আমি আমার তুহিন হত্যার বিচার চাই। যারা আমার তুহিনরে বিনা দোষে গুলি করে হত্যা করেছে তাদের বিচার দেখে আমি মরতে চাই।’
তুহিন মিয়ার চাচা মো. আবুল হোসেন (৪২) প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বাসসকে জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০ জুলাই বিকালে গাছা বাজার থেকে অটো যাত্রী নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রী নামানোর পর তার ভাতিজা তুহিন মিয়া অটো স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিল দেখছিলো। এ সময় বিজিবি সদস্যরা গুলি চালালে একটি গুলি তুহিনের থুঁতনি বরাবর প্রবেশ করে ঘাড়ের পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়।
বিজিবির মুহুর্মুহু গুলির ভয়ে কেউ তুহিনকে তখন উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যেতে সাহস করেনি। ফলে বেশ কিছু সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকাবস্থায় তুহিনের ব্যাপক রক্তক্ষরণ ঘটে। বিজিবি চলে যাওয়ার পর লোকজন তাকে গুটিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন গাছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজার নামাজ শেষে তুহিন মিয়াকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
গাজীপুর মহানগরীর গাছা ২ নং কলোনীর ছোট একটি টিনের ঘরে বাবা, মা, ভাই, ভাবি ও দাদিকে নিয়ে থাকতেন শহিদ তুহিন। এই কলোনীর দুই রুমের টিনের ছাপরা ঘরই তাদের একমাত্র ঠিকানা। তুহিনের বাবা মো. বাবুল মিয়া (৪৬) পেশায় অটো চালক। তবে নানাবিধ রোগব্যাধির কারণে বেশিরভাগ সময় কাজে বের হতে পারেননা। মা তাসলিমা বেগম (৩২) গৃহিণী ছিলেন। সংসারের প্রয়োজনে অল্পকদিন আগে গার্মেন্টস এ চাকুরি নিয়েছেন। বড় ভাই তুষার মিয়া (২৭) কিছুদিন আগে ৫ লাখ টাকা ঋণ করে সৌদি আরব গেছেন। ছোট ভাই হাসান মিয়া (১৩) স্থানীয় গাছা উচ্চ বিদ্যলয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে।
একমাত্র বোন সুমি আক্তারের(২০) বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে। তুহিন অটো চালিয়ে যে আয় করতো তা নিয়ে অভাবের সংসারটা কোনমতে চলতো বলে জানান তার একমাত্র চাচা আবুল হোসেন। তুহিনের দাদী ময়ফল বেগম (৭০) বলেন, ‘আমার নাতিডাতো কারো কোন ক্ষতি করেনাই। দিনভর আমার নাতি অটো চালাইতো। নাতিডায় আমারে ওষুধবড়ি কিনা দিতো। আমার এতো সুন্দর নাতিরে যে মারছে আল্লাহ তার বিচার করবো।’
চার বছরের শিশু ফাতেমা তার চাচ্চুকে এখনো ভুলতে পারছেনা। আদরের ভাতিজি ফাতেমার চকোলেট, চিপস খাওয়া, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়াসহ সব বায়না ছিলো ওর চাচ্চুর কাছে। তুহিন মিয়া সর্বশেষ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ফাতেমা চাচ্চুর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরেছিলো। তুহিন মিয়া ভাতিজিকে দোকানে নিয়ে চিপস কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আরেকদিন আমরা ঘুরতে যাবো।’ ফাতেমা তার দাদুকে বলে ‘চাচ্চুতো মরেনাই। চাচ্চু আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। আমাকে অনেক কিছু কিনে দিবে।’
গাছা বাজারের পরিবহন ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন ভুঁইয়া জানান, তুহিন মিয়া খুব ভালো ছেলে ছিলো। কোন রাজনীতি করতো না। পরিশ্রমী ছিলো। তার আয় দিয়েই মূলত তাদের সংসারটা চলতো। তুহিনের বাবা বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। মা গৃহিণী ছিলেন। কিন্তু তুহিনের মৃত্যুর পর কয়েকদিন আগে বাধ্য হয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছেন।
শহিদ তুহিনের মা তাসলিমা বেগম বাসসকে জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের দুই লাখ টাকা সহযোগিতা দেয়া হয়েছে।