শিরোনাম
প্রতিবেদন : মোহাম্মদ বাইজিদ হোসাইন
চট্টগ্রাম, ২৯ নভেম্বর ২০২৪ (বাসস) : দিনমজুর কিশোর রমজান আলী আরমান। বয়স ১৫ বছর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে কষ্টে কেটেছে কয়েকমাস।
জীর্ণশীর্ণ ছোট্ট শরীরে এ পর্যন্ত সার্জারি হয়েছে আট বার। এক সময় নাড়িভুঁড়িতে তো অন্য সময় প্রস্রাবের রাস্তায়, আবার কোনো সময় তলপেটে অপারেশন হয়েছে ছোট্ট আরমানের। হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে নানার বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চন নগরে চলে গেছেন আরমান ও তার মা হিরা আক্তার (৩৮)।
গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আরমান। ছররা গুলিতে তার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে গেছে। কোমরে ও উরুতেও গুলি লেগেছে। মলদ্বার বাইপাস করা হয়েছে। গুলিতে ইউরিনারি বর্ডারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
তার চিকিৎসায় চড়া সুদে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন রিকশাচালক পিতা মো. মনসুর (৪৫)। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের পেছনেই সেই টাকাও শেষ হয়েছে। এখন অসহায় মানবেতর জীবনযাপন করছে পুরো পরিবার।
জানা গেছে, নগরের মুরাদপুর এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক শোরুমের পেছনে মোহাম্মদপুর এলাকায় মাসিক ৬ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় দুই ছেলে এবং স্বামীকে নিয়ে বসবাস করতেন ছাত্র আন্দোলনে আহত আরমানের পরিবার। আরমানের বড় ভাই আরাফাত উল্লাহ (১৮) বাকপ্রতিবন্ধী। আরমান মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। তবে অভাবের সংসারে পড়ালেখা বেশিদূর এগোয়নি।
দিনমজুর এই কিশোরের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা চিকদাইর নোয়াহাট এলাকায়। মা হিরা আক্তার। বয়স ৩৭ বছর। গ্রামের বাড়ি রাউজান হলেও ১৯ বছর নগরের মুরাদপুর এলাকায় থাকেন।
আরমান নগরের মির্জাপুর এলাকায় সিলভারে হাঁড়ি-পাতিল তৈরির একটি কারখানায় দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে কাজ করতো। ঘটনার দিন সে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে ঝালমুড়ি খেতে মায়ের কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলো।
হিরা আক্তার বাসসকে বলেন, গত ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরে আরমান। পরে ঝালমুড়ি খাবে বলে ২০ টাকা নিয়ে বের হয়।
কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়, আরমান আর ফিরে আসে না। সন্ধ্যার দিকে বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হিরার কানে ভেসে আসছিলো। ছেলে আরমান ঘরে ফিরে না আসায় চিন্তা বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছেলের খোঁজে বাসা থেকে বের হন হিরা। পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানায় গিয়ে ছেলের ছবি দেখায় দায়িত্বরত পুলিশদের। আরমানের কোনো হদিস পাচ্ছিলেন না হিরা। রাত ৮টার দিকে স্বামী-স্ত্রী দুজন যান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু কেউ আরমানের খোঁজ দিতে পারছিলেন না। সন্তানের হদিস না পেয়ে হতাশ হয়ে বাসায় ফেরেন হিরা ও তার স্বামী মনছুর।
হিরা আরও জানান, তার বড়ছেলে আরাফাত উল্লাহ চান্দগাঁও থানাধীন বলিরহাট এলাকার একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। ঘটনার দিন (১৮ জুলাই) সন্ধ্যার পর কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে বহদ্দারহাট মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা কৌতূহল বশত নিজের মোবাইল ফোনের ভিডিওতে ধারণ করে আরাফাত। ১৯ জুলাই সকাল ৭টার দিকে ভিডিওটি খালাকে দেখায় আরাফাত উল্লাহ। ভিডিওটি ধারণ করার সময় আরাফাতকে উদ্দেশ্য করে ‘তোমার ভাইয়ের পেটে গুলি লেগেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে’ বলে এক শিশুকে বলতে শোনা যায়। ওই শিশু আরমান ও আরাফাতকে চিনত বলে জানান হিরা আক্তার।
১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বলির হাটে গিয়ে ওই শিশুর সন্ধান পান হিরা। আগের দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে বহদ্দারহাট এলাকায় আরমান কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল এবং কারা তার ছেলেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছেন সে বিষয়ে হিরা আক্তারকে বর্ণনা দেয় শিশুটি। এরপর দুপুর ১২টার দিকে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে গিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ সন্তানের সন্ধান পান হিরা। কিন্তু সেদিন হাসপাতালের বেডে অচেতন অবস্থায় আরমানকে দেখে জ্ঞান হারান হিরা আক্তার।
চিকিৎসকেরা সেদিনই হিরাকে জানান, তার ছেলে বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। গুলিতে আরমানের পেটের নাড়িভুঁড়ি ও প্রস্রাবের রাস্তা ছিঁড়ে গেছে।
হিরা আক্তার জানান, সাতদিন পর ক্যাজুয়ালিটি বিভাগ থেকে ছেলের ছাড়পত্র পান তিনি। বাসায় ফিরে যাওয়ার পাঁচদিন পর আরমানের পা দুটি অবশ হয়ে যায়। এরপর চমেক হাসপাতালের ২৫ নং, ৭৯ নং এবং ২৭ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলে আরমানের। ২২দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন সার্জারি ওয়ার্ডের ২৪ নম্বর বেডে। এরপর চিকিৎসার ব্যয় ভার বহন করতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে তার নানার বাড়ি গিয়ে উঠেছেন হিরা আক্তার।
ছেলের চিকিৎসার খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে হিরা আক্তার জানান, তিনি আগে গার্মেন্টসে সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে দেখাশোনার জন্য ওই চাকরি তিনি ছেড়ে দেন। গত ১৯ বছর ধরে স্বামী এবং দুই সন্তান নিয়ে মুরাদপুরের মোহাম্মদপুর এলাকায় ছয় হাজার টাকার একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছিলেন হিরা। কিন্তু ছেলের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সেই বাসাটিও চলতি মাসের শেষে ছেড়ে দেবেন। তার স্বামী পেশায় রিকশাচালক। কিন্তু তিনি নানা রোগশোকে আক্রান্ত। বড় ছেলে বাক প্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে মাসের পর মাস।
‘ছেলের নানা পরীক্ষা, ওষুধ কেনার পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে ৫০ হাজার টাকা। সংসারে তো অভাব। সুদি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছি এখন সেই টাকাও শেষ’ হতাশার সুরে বলেন হিরা আক্তার।
হিরা জানান, অভাবের সংসারে করুণ দৈনতায় কাটছে তাদের জীবন। তবে চমেক হাসপাতালে নিয়মিত এসে ভগ্নিপতি মামুন তার ছেলে আরমানের খোঁজ নেন।
কিন্তু অর্থ সংকটেই তারা এখন কাহিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। তারা চান, সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোন দিক থেকে কেউ তাদের সাহায্য করুক। না হলে পরিবার নিয়ে দুর্দশার অন্ত থাকবে না বলে হিরা আক্তার জানান।