বাসস
  ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪০

বিজয় মিছিলে গিয়ে নিখোঁজ হন স্বামী, সন্ধান না মিললে শহিদের স্বীকৃতি চান স্ত্রী

প্রতিবেদন: কালাম আজাদ

বগুড়া, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একপর্যায়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। এর পর বিজয় মিছিলে যোগ দেয় হাজারো জনতা। তাদেরই একজন মনিরুজ্জামান মিলন (৩০)। মিছিলে যোগ দেন ঠিকই, কিন্তু আর ফিরে আসেননি তিনি।

ছেলের কি পরিণতি হয়েছে তা জানেন না মিলনের বৃদ্ধা মা মেরিনা বেগম। স্ত্রী সুবিতা খাতুনও স্বামীর খোঁজ চান। শিশু কন্যা মানসুরা কে নিয়ে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন তিনি।

তিনি জানান, স্বামীর কী পরিণতি হয়েছে, এটা আমাদের জানার অধিকার আছে। তাকে খুঁজে বের করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করছি। না পাওয়া গেলে আমার স্বামীর ‘শহিদ’ হওয়ার স্বীকৃতি চাই।

মা বৃদ্ধা মেরিনা বেগমের সামনে মিলনের নাম কেউ বললেই তিনি কাঁদতে শুরু করেন। থামানো যায় না কিছুতেই। স্বজনেরা ধরে নিয়েছেন মিলন আর বেঁচে নেই। ছেলে জীবিত ফিরবেন, এমন আশা ছেড়ে দিয়েছেন মেরিনা বেগমও।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের জোড়গাছা গ্রামে মিলনের বাড়ি। বাবা সুরুজ্জামান মারা গেছেন আগেই।

উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর মিলন ঢাকায় মেকানিকের ওপর দুই বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করেন। এরপর ২০১৪ সালে চাকরিতে যোগ দেন। বিয়ে করেন ২০২১ সালে। গত ১৫ জুলাই সাভারের আশুলিয়া ইপিজেডে একটি ডাইং কারখানায় সিনিয়র মেকানিক পদেযোগ দেন তিনি।

আশুলিয়া থানার বিপরীত পাশে বুড়িবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নেন। ২৬ জুলাই স্ত্রী সুবিতা খাতুন ও ১৪ মাসের কন্যা মানসুরা মারিয়ামকে নিয়ে নতুন বাসায় ওঠেন। মিলনের মা অসুস্থ থাকায় স্ত্রী-সন্তানকে ২৮ জুলাই গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদছেড়ে বাধ্য হয়ে পালিয়ে যান ভারতে। এই খবর শুনে দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সেই আনন্দ উপভোগ করতে মিলনও নামেন রাজপথে। আশুলিয়া এলাকায়। বিকেলে মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন মিলন।

ছেলের স্মতিচারণ করে মেরিনা বেগম বলেন, মিছিলে যাওয়ার আগে মিলন ফোন করেছিল। সে মিছিলে যেতে চাচ্ছিল। আমি নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু নিষেধ উপেক্ষা করে মিছিলে যায় সে। এরপর সে আর ফেরেনি। তার ব্যবহৃত ফোনও বন্ধপাওয়া যায়।

জানা গেছে, ৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় ৪৬ জন মারা গেছে। ওই সময় অনেকেই নিখোঁজ হন। ৪৬ লাশের মধ্যে আশুলিয়া থানার সামনে একটি পিকআপ ভ্যানে ১১টি লাশে আগুন ধরিয়ে দেয় পুলিশ।

মিলনের স্বজনরা জানান, ৫ আগস্টের পর মিলনের সন্ধানে হাসপাতাল, ক্লিনিক,মর্গ, থানা, এমন কোনো জায়গা নেই যে খোঁজ করার বাকি আছে। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা নিশ্চিত না হলেও স্বজনদের ধারণা, পুলিশ গুলি করে হত্যার পরলাশ গুম করে দিয়েছে।

মিলনের স্ত্রী সুবিতা খাতুন জানান, ৫ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে শেষবারের মতো স্বামীর সঙ্গে তার কথা হয়। আশুলিয়া এলাকায় তখন মিলন আনন্দ মিছিল চলছিল। মানুষের উল্লাস আর হৈ চৈয়ের কারণে বেশি কথা হয়নি। স্বামীকে সাবধানে থাকার কথা বলি। এর আধাঘণ্টা পর থেকে একাধিকবার কল করলেও মিলন আর ধরেনি।

সুবিতা বলেন, ‘সেদিন যদি অনুরোধ করে মিছিল থেকে বাসায় ফিরে যেতে বলতাম, তাহলে তাকে হারাতে হতো না। বাচ্চাটা সব সময় বাবা বাবা করে। তার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার স্বামীর কী পরিণতি হয়েছে, এটা জানার অধিকার আমার আছে। তাকে খুঁজে বের করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করছি। না পাওয়া গেলে আমার স্বামীর শহিদের স্বীকৃতি চাই।’

মিলনের বড় ভাই সামিউল ইসলাম মিল্টন কলেজশিক্ষক। গত ৫ আগস্টের পর একাধিক দিন মিলনের খোঁজ করেছেন বলে জানান। 

মিল্টন বলেন, ঘটনার দিন রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত তার মোবাইল ফোনে কল গেছে। এরপর ফোন বন্ধ পাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ে।
মিলনের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। সাভার-আশুলিয়া এলাকায় কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অনেক খোঁজাখুজি করেও মিলনকে পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের সব ওয়ার্ড ও মর্গে খুঁজেও মিলনের সন্ধান পাননি বলে জানান মিল্টন। পরে কাকরাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও মিলনের সন্ধান করেন স্বজনরা। সেখানেও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি মিলনের।

মিলনের সন্ধান না পেয়ে ১১ ও ২১ আগস্ট আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যান সুবিতা ও সামিউল। থানা পুলিশ তাদের লিখিত অভিযোগপত্র জমা নিলেও সেটি জিডি বা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেনি।

সামিউল বলেন, ২১ আগস্ট আশুলিয়া থানায় লিখিত অভিযোগপত্র জমা নেওয়ার পরজানিয়ে দেওয়া হয়, এক পুলিশ কর্মকর্তা যোগাযোগ করবেন। কিন্তু জিডি নম্বরবা সিল-স্বাক্ষর কিছুই দেয়নি। পরবর্তী সময়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগও করেনি।
 
জানা যায়, তখন আশুলিয়া থানায় ওসি ছিলেন এ এফ এম সায়েদ। গত ৫ আগস্টের পর তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়ায় তিনি আত্মগোপনে আছেন।

এদিকে মিলনের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান।