শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল? আমাকে কেন বিধবা হতে হলো? আমার ছেলে কেন বাবাকে হারালো? আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানী ঢাকার বংশালে গত ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হওয়া মো. সোহাগের (৩৬) স্ত্রী সাবিনা আক্তার রুনা।
তিনি একনাগাড়ে প্রশ্ন করেন, ‘আমার সুখের সংসারে এমন পরিস্থিতি কেন হলো? এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কে দেবে? আমার সংসার কিভাবে চলবে? ছেলের ভবিষ্যত কি হবে? আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? কিভাবে চলবে আমার ও ছেলেটার জীবন?।’
সম্প্রতি রাজধানীর লালবাগের বাবার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ফার্নিচার ব্যবসায়ী শহিদ সোহাগের স্ত্রী সাবিনা আক্তার রুনার সাথে।
তিনি বলেন, ছেলেটার বয়স চার বছর। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সব সময় মন খারাপ করে থাকে ছেলেটা। কিছু খেতে চায় না, বাবার কথা মনে হলেই কান্না শুরু করে। ওর বাবা যে আল্লাহর দরবারে চলে গেছে, সেটা কোন ভাবেই মানতে চায় না। ছোট বাচ্চা বুঝতে চায় না, কি করবো ছেলেটাকে নিয়ে। আসলে ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে আমি অনেক বেশি চিন্তিত। ওর বাবা ব্যবসা করে যা আয় করেছে, সেখান থেকে তো আর জমানো সম্ভব হয়নি। আগামী বছর ওকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে, কিন্তু স্কুলের বেতন কি ভাবে পরিশোধ করবো?
সাবিনা আক্তার রুনা বলেন, সোহাগ নিহত হওয়ার পর শাশুড়ি ও ননদ আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। তারা আমার ও ছেলেটার কোন খবর নেয় না। এমন কি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শহিদদের জন্য সরকার এবং জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে যে সহযোগিতা দেওয়ার কথা সে টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রেও শাশুড়ি অনেক ঝামেলা করছে। আমি এখনও সেই টাকা তুলতে পারি নাই।
শহিদ সোহাগ ১৯৮৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বংশাল লেনের ৩৫ নং ওয়ার্ডের কোতোয়ালি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কামরাঙ্গীচর এলাকায় ফার্নিচারের ব্যবসা করতেন। এক ভাই-এক বোনের মধ্যে সোহাগ ছিলেন বড়। বাবা গোলাম মোহাম্মদ মারা গেছেন অনেক আগেই। মা সামিনা খাতুন (৫৫) গৃহিণী।
২০১৮ সালে ভালোবেসে মো. সোহাগ ও রুনা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে একমাত্র পুত্র দাউদ শেহরান জন্মগ্রহণ করে। মা, স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বংশাল লেনের ৩৫ নং ওয়ার্ডের কোতোয়ালি এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকতেন সোহাগ। রুনা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন।
সাবিনা আক্তার রুনা বলেন, এত ছোট বয়সে ছেলেটা তার বাবাকে হারিয়েছে। আমার পিতা আগে ব্যবসা করতেন। বয়সের কারণে এখন কিছু করতে পারেন না। তিনি কানে ঠিক মত শুনতে পান না। আমিও কোন চাকুির করি না। বাবার সংসারে কত দিন থাকবো? ছেলেটাকে কিভাবে পড়া লেখা শেখাবো? পড়ালেখা করাতে গেলে তো অনেক খরচ। আমি সেই খরচের টাকা পাবো কোথায়? এখন ছেলেটার ভবিষ্যত কি হবে?
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সোহাগের স্ত্রী রুনা বলেন, আমার স্বামী বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে সে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে বের হয়। পরে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে এসে একটু খাওয়া দাওয়া করে আবার বের হয়। রাত সাড়ে আটটার দিকে ফোনে খবর আসে বংশাল মোড়ে সোহাগের গুলি লাগছে। আমরা খবর পেয়ে দৌড়ে সেখানে যাই। গিয়ে শুনি তাকে মিডফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরে আমরা সেখানে যাই। গিয়ে আমরা স্বামীর লাশ খুঁজে বের করি।
এই বলে তিনি কান্না শুরু করেন।
কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেন, আমরা স্বামীর দেহ কাটা-ছেঁড়া হোক আমি তা চাইনি। আবার ময়নাতদন্তের জন্য ওর আগেও অনেক জন সিরিয়ালে ছিল। ময়নাতদন্ত করতে গেলে অনেক দেরি হতো। তাই ময়নাতদন্ত ছাড়াই ৬ তারিখ সকাল ১০ টার দিকে বংশাল পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। সকল ধরনের ঝামেলা এড়াতেই ময়নাতদন্তের বিষয়টি আমরা এড়িয়ে যাই।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে তিনি সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালনোর পরও বিকেল থেকে বংশালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের সংঘর্ষ চলতে থাকে। সন্ধ্যায় সোহাগ বাসা থেকে খাবার খেয়ে মিছিলে যোগ দিতে বের হয়ে যখন বংশাল মোড়ের দিকে যায় তখন তার বুকের ডান দিকে গুলি লাগে।
রুনা বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা কি ভাবে বলবো। সেদিনের কথা মনে হলেই বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। ছেলেটা সারাদিন আব্বু আব্বু বলে ডাকাডাকি করে। ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আর কোন পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয়।
আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি জানান, বাচ্চার নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। ওকে সঠিক ভাবে পড়ালেখা শেখাতে চাই। আমার কোন ভাই নেই। আমরা তিন বোন। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের বয়স হয়ে গেছে। আমি তাদের কাছে কত দিন থাকবো। সরকার যদি আমাকে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিত তাহলে সন্তানকে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারতাম। তাই সরকারের প্রতি আহবান, আমার শিশু সন্তানের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে যাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
পাশাপাশি যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
শহিদ সোহাগের শ্বশুর মো. হুমায়ুন বলেন, আমার বয়স হয়ে গেছে। তিনটা মেয়ে আমার, সবাইকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট মেয়েটার ভাগ্য খারাপ। মাত্র ৬ বছর সংসার করে স্বামীকে হারালো। নাতিটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার জামাইটা খুব ভালো মানুষ ছিল। আল্লাহর নিকট একটাই চাওয়া সে যেন জান্নাতবাসী হয়। সরকারের প্রতি অনুরোধ করবো মেয়েটার যেন একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয়।