শিরোনাম
প্রতিবেদন : রুপোকুর রহমান
সাভার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বাবা কেনো আর বাসায় আসে না? বাবা কোথায় গেছে? বাবার কি হয়েছে?
ছয় বছরের ছোট্ট শিশু তানহা’র এসব প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারে না। তানহা সারাক্ষণ বাবাকে খুঁজে ফেরে। প্রশ্ন করে দাদি আর ফুফুদের।
কিন্তু তার বাবা যে আর ফিরবেন না। এ সত্যটা বুঝতে পারছে না তানহা। তার বাবা সুজন মিয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে শহিদ হয়েছেন। বাবা যে না ফেরার দেশে এ কথা শিশু তানহাকে এখন কে বুঝাবে?
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের পাকিজা মোড়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হন অটোচালক সুজন মিয়া (২৩)। আশংকাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শহিদ সুজন মিয়ার বাবার নাম মোস্তফা কাজী। তাদের গ্রামের বাড়ী নরসিংদীর শিবপুর থানার ঘাসিরদিয়া গ্রামে। বেশকিছুদিন ধরেই তারা বসবাস করছেন সাভারের রাজাশন রোডের মজিদপুরস্থ রাজী মিয়ার ভাড়া বাড়ীতে। একমাত্র কন্যা তানহা এবং বাবা মোস্তফা কাজী আর মা রেখা বেগমের সাথেই থাকতেন সুজন মিয়া।
বনিবনা না হওয়ায় স্ত্রী লাইজু আক্তারের সাথে বছর পাঁচেক আগে সুজন মিয়ার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর থেকে শিশু কন্যা তানহা সুজন মিয়ার সাথেই থাকতো। বাবা মোস্তফা কাজীও মারা গেলে পুরো পরিবারের ভার এসে পড়ে সুজন মিয়ার ওপর। অটোরিক্সা চালিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তিনি। এভাবেই চলছিল সুজন মিয়ার সংসার জীবন।
কিন্তু গত ৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটের আঘাত লণ্ডভণ্ড করে দেয় পুরো পরিবারটিকে। এতিম হয়ে যায় শিশু তানহা। সেই সাথে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা রেখা বেগমও। কিভাবে চলবে নাতনি আর দাদির সামনের দিনগুলো এ নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
সুজন মিয়ার বড় বোন হাজেরা বেগম বাসস’কে বলেন, ‘শুরুর দিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয় সুজন। তখন সেগুলো ওর শরীর থেকে আমিই বের করি। ঘটনার দিন ৫ আগস্ট দুপুরে সুজন ঘুম থেকে উঠে অটোরিক্সা নিতে গ্যারেজে যায়। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি ভালো না থাকায় গ্যারেজ মালিক রিক্সা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় চলে আসে সে। এর কিছুক্ষণ পরপরই হাসিনা সরকারের পতনের খবর পেয়ে সুজন ও তার বন্ধুরা মিলে আনন্দ মিছিল নিয়ে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের দিকে যায়। এ সময় তারা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার পাকিজার মোড় এলাকায় গিয়ে আনন্দ মিছিল করে। মিছিলে নির্বিচারে গুলি করে পুলিশ। সুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয়রা তাকে ধরাধরি করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
তিনি আরো বলেন, দীর্ঘক্ষণ ছেলের খোঁজ না পেয়ে আমার মা ছেলে সুজনের জন্যে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে গেলে ওর পরিচিত একজন আমার মা’কে বলে সে তো গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ওকে সাভারের এনাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন আমার মা দ্রুত আমাদের বাসায় এসে সুজনের গুলিবিদ্ধের খবর দেয়। আমি, আমার চাচা, মাসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন দ্রুত এনাম মেডিকেলে গিয়ে আমার ভাই সুজনের লাশ দেখতে পাই।
হাজেরা বেগম বলেন, আমরা বাবা-মায়ের তিন বোন। আর একমাত্র ভাই ছিল সুজন। পরিবারের ছোট আর একমাত্র ভাই হওয়ার সুবাদে ও ছিল সবার আদরের। কোনদিন কোন ঝামেলায় যেত না ও। পরিবারের জন্য অনেক পরিশ্রম করতো। বাবার মৃত্যুর পর ওই আমার মা আর ওর সন্তানের ভরণ-পোষণ করে আসছিল। সবাইকে একা করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আমাদের আদরের ভাইটি।
এ অবস্থায় মা ও শিশু সন্তান তানহার ভবিষ্যৎ বিবেচনায় সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
সুজন মিয়ার বোন জামাই (দুলাভাই) শহীদুল ইসলাম বাসস’কে বলেন, সুজন ছোট বেলা থেকেই ছিল পরিশ্রমী। কোনদিন কখনো কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি তাকে। ওকে আমরা সবাই অনেক আদর করতাম। ও আমাদের সম্মান করতো। আমাদের পরিবারকে শুন্য করে দিয়ে গেছে ও।
এ ঘটনায় সুজনের হত্যাকারী ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের পাশাপাশি অসহায় এ পরিবারের পাশে সংশ্লিষ্টদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
সুজন মিয়ার চাচা মজিবর কাজী বাসস’কে বলেন, সুজনের গুলিবিদ্ধের খবর আমি প্রথমে ওর মা’র কাছ থেকে শুনতে পাই। পরে আমরা সবাই ছুটে যাই এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে প্রতিটি ফ্লোরে খুঁজে ফিরি সুজনকে। কিন্তু কোথাও ওর হদিস পাইনি। হাসপাতালের গুলিবিদ্ধের তালিকায় সুজনের নাম থাকলেও কেউ ওর সন্ধান দিতে পারছিল না। পরে হতাশ হয়ে আমরা যখন হাসপাতাল থেকে ফিরে আসছিলাম তখন ওখানকার একজন বলে ওইদিকে লাশ ঘর। ওখানে গিয়ে দেখতে পারেন আপনারা। তখন আমি ওই লাশ ঘরে গিয়ে দেখতে পাই সুজনের মৃতদেহ পড়ে আছে। পরে গ্রামের বাড়ী নরসিংদী নিয়ে ওকে দাফন করি।
তিনি আরো বলেন, সুজন ছেলে হিসেবে ছিল অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের। ওর বাবার মৃত্যুর পর ওই হাল ধরেছিল পরিবারের। ওর মা ছাড়াও পরিবারে ওর তানহা নামের একটি ছোট্ট শিশু কন্যা রয়েছে। সুজনের মৃত্যুর পর ওর কন্যা শিশুটি এতিম হয়ে গেলো। আর ওর মা’ও এখন অসহায়। এমন অবস্থায় তাদের সংসার কিভাবে চলবে আল্লাহই ভালো জানেন।
সুজন মিয়ার মা রেখা বেগম মুঠো ফোনে বাসস’কে বলেন, সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে আমিই প্রথম সুজনের এক বন্ধুর মাধ্যমে গুলিবিদ্ধের খবর পাই। পরে হাসপাতালে গিয়ে ওর মৃতদেহ দেখি। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে সুজনই হাল ধরেছিল পরিবারের। অটোরিক্সা চালিয়ে সংসার চালাতো ও। আমি আর সুজনের একমাত্র কন্য তানহা ছিল আমাদের পরিবারে। ছেলের মৃত্যুতে আমরা এখন অসহায় হয়ে পড়েছি। আজ এ মেয়ের কাছে তো কাল অন্য মেয়ের কাছে থাকতে হচ্ছে আমাদের। এমনভাবে কি আর জীবন চলে?
অসহায়ভাবে তিনি আরো বলেন, আমার জীবনতো শেষ পর্যায়েই। আমি আর কতোদিন! চিন্তা হলো সুজনের এই অবুঝ এতিম শিশু কন্যা তানহার জন্য। কিভাবে ও বড় হবে, কে ওর দেখভাল করবে, ওর ভবিষ্যতই বা কি? সব মিলিয়ে বড় দুঃশ্চিন্তায় আছি আমরা সবাই।
এ অবস্থায় শিশু তানহার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সমাজের বিত্তবানসহ সরকারের সংশিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।