বাসস
  ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৫৭

মানুষের বন্ধু ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ঢাকা, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : ডলফিন শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে পানিতে দাপাদাপি করে সাঁতরে বেড়ানো এক উচ্ছল প্রাণীর ছবি। কখনো সমুদ্রগামী জাহাজের সামনে দলবেধে ঢেউ কেটে এগিয়ে চলা ডলফিনের দলকে দেখলে মনে হয় জাহাজকে পথ দেখানোর খেলায় মেতেছে। সাগরে জীবন বিপন্ন মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা এই প্রাণিটিকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদের কাতারে ধরা হয়। বদ্ধ জলাশয়ে তাদের নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন কারসাজি দেখানোরও ব্যবস্থা করা হয়। সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে এদের জুড়ি মেলা ভার। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা মানবসমাজের কাছে ডলফিনকে খুবই জনপ্রিয় করে তুলেছে। 

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, স্তন্যপায়ী ডলফিন ৪ ফুট দৈঘ্যের্র এবং ৪০ কেজি  ওজন থেকে শুরু করে ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১০ টন ওজন পর্যন্ত বিভিন্ন আকারের হয়। পৃথিবীতে ১৭টি গণে প্রায় ৪০টি প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। পৃথিবী জুড়েই ডলফিন দেখা যায়, বিশেষ করে মহীসোপানের কাছের অগভীর সমুদ্রে। ধারণা করা হয় দশ মিলিয়ন বছর আগে মায়োসিন যুগে ডলফিনের উদ্ভব।

এই ডলফিন বা শুশুক  নদী ও সমুদ্রের সৌন্দর্যের পাশাপাশি আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক। জলজ বাস্তুসংস্থানের স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে এই প্রজাতির ওপর। বিশেষ করে মিঠা পানির ডলফিন জলজ প্রাণীদের খাদ্য শৃঙ্খল সুরক্ষিত রাখে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ যখন আমাদের নদী, হ্রদ ও সাগরকে বিপর্যস্ত করে তুলছে, তখন ডলফিন এক ধরনের প্রাকৃতিক 'সতর্ক বার্তা' দেয়। যদি ডলফিনের সংখ্যা কমতে থাকে বা তাদের মধ্যে রোগ দেখা দেয়, তা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে দূষণ বা অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। তাই ডলফিনের অবস্থান এবং সংখ্যা পরিবেশের সঠিক অবস্থা জানার অন্যতম প্রধান মানদ- হিসেবে বিবেচিত। ডলফিন মাংস ভোজী প্রাণী। মাছ ও স্কুইড এদের প্রধান খাদ্য। তারা শিকারি হিসেবে দুর্বল ও অসুস্থ মাছ খায়, যা পানির জীববৈচিত্রকে স্বাস্থ্যকর রাখে। ডলফিনের এই শিকার করার প্রবণতা সমুদ্রের মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডলফিনের সংরক্ষণ সামুদ্রিক জীবনের অন্যান্য প্রজাতির জন্যও উপকারী, কারণ তাদের অনুপস্থিতি বা সংখ্যার হ্রাস সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।

বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অন্যান্য ডলফিন সমৃদ্ধ দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও মিঠাপানির ডলফিন সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর মতো এবারও বন অধিদপ্তর ২৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস পালন করবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- 'নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক'। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে ঢাকায় বন ভবন, ছাড়াও পাবনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাগেরহাটে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

আমাদের দেশে নদ-নদীতে দু’ধরণের ডলফিন আছে- শুশুক ডলফিন আর ইরাবতী ডলফিন। আই.ইউ.সি.এন এর গ্লোবাল রেড লিস্ট ক্যাটাগরিতে দুটোই বিলুপ্তির ঝুঁকির সম্মুখীন বা ‘এন্ডেঞ্জার্ড এনিম্যাল’। ইরাবতীদের বাস আমাদের ৭২০ কিমি উপকূলীয় নদী কিংবা সাগরমুখে আর শুশুক ডলফিন বিচরণ করছে দেশে বিদ্যমান ৭০০ নদীর ২৪ হাজার কিমি এলাকার একটি বড়ো অংশ জুড়ে। যদিও বর্ষা মৌসুম ব্যতিরেকে শুষ্ক মৌসুমে এদের আবাসস্থল কমে বেশ সংকুচিত হয়ে যায়। আশার কথা হলো আমাদের প্রমত্তা পদ্মা, যমুনা, মেঘনাসহ, ব্র্রহ্মপুত্র, হালদা, বলেশ্বর, গড়াই-মধুমতী, ডাকাতিয়া প্রভৃতি নদীই রিভার ডলফিনের উপযুক্ত আবাসস্থল।  

বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর ডলফিনসহ অন্যান্য প্রজাতির ডলফিন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো নদীর দূষণ, মাছ ধরার জাল, জলবিদ্যুৎ বাঁধ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর প্রবাহে পরিবর্তন। এদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের বাস্তুসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলছে।

বাংলাদেশ সরকার এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ডলফিন সংরক্ষণে বেশ কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে। গঙ্গা নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ডলফিনের বাস্তুসংস্থান উন্নত করার পাশাপাশি তাদের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। গাঙ্গেয় ডলফিনকে সংরক্ষিত প্রজাতির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে, যা এদের রক্ষার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

দেশব্যাপী ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করার জন্য এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন অধিদপ্তর শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিনকে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছে।  এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হলে ডলফিন সংরক্ষণ আরও গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা যায়। এর বাইরে, মিঠা পানির ডলফিন সংরক্ষণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। গবেষণার পাশাপাশি ডলফিনের গতিবিধি ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং প্রজনন সংক্রান্ত উদ্যোগও গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন নদীতে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও নদী দূষণ রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ডলফিন সংরক্ষণে সফলতা পেতে হলে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিক, রাসায়নিক পদার্থ, এবং অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য নদীতে ফেলার ফলে ডলফিনের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ডলফিন আমাদের জীববৈচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাদের রক্ষা করা আমাদের পরিবেশগত দায়িত্ব। কাজেই ডলফিন সংরক্ষণে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনের ওপরও তারা গুরুত্বারোপ করেছেন।