বাসস
  ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩:২১

জাতীয় জীবনের সমস্যাগুলো জোর দিয়ে বলতেন অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন: আবুল কাসেম

ঢাকা, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং চেতনার অগ্রগতিতে অবিস্মরণীয় একজন মানুষ ছিলেন অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন। আমাদের জাতীয় জীবনের সমস্যাগুলো খুব জোর দিয়ে বলতেন তিনি। পূর্ববর্তী মহৎ লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।’
 
আজ বুধবার বিকাল ৪টায় বাংলা একাডেমি লেখক, শিক্ষাবিদ ও ফোকলোর বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ১২১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক সেমিনার আয়োজন করে। ‘মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের শিল্পভাবনা : নৃ-সংগীতবিদ্যার আলোকে’ শীর্ষক সেমিনারটি বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।

অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ‘মনসুরউদ্দিন নানান বিষয়ে লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে দুই খণ্ডে বই আছে মনসুরউদ্দীনের। যারা ইতিহাস লিখেছেন কেউই এটির উল্লেখ করেননি। যারা সাহিত্যের ইতিহাস লেখেন তাদের উচিত মনসুরউদ্দীনের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে লেখা বই দুটির উল্লেখ করা।’

মনসুরউদ্দীন বুদ্ধিজীবী মহলে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন উল্লেখ করে অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ‘যারা এই জাতীর জনগণের কল্যাণে অতীতে কাজ করে গেছেন তাদের স্মরণ  করা, তাদের চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। তখনকার লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংখ্যাটা কম ছিল। সরকার বুদ্ধিজীবীদের সরকারের দিকে নিতে নানাভাবে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতেন না।’  

তিনি আরও বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মনসুরউদ্দীন গান সংগ্রহ করেছেন। এগুলোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কখনো তিনি টাকা নেননি। মনসুরউদ্দীন বুদ্ধিজীবী সমাজে খুব সম্মানিত ছিলেন। কারণ তিনি এই অঞ্চলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতেন না।’

সেমিনারে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ আলোচক ছিলেন। সেমিনারে অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইম রানা।

মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন লোকসংগীত, লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ। তিনি ১৯০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জায়দার আলী এবং মাতার নাম জিউয়ারুন নেসা। ১৯২৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। পরের বছর অস্থায়ী স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগদান করে তিন বছর চাকরি করেন। এরপর ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (স্কুল শাখা), হাওড়া জেলা স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫২ সালে ছয় মাসের জন্য তিনি ঢাকায় সরকার পরিচালিত ‘মাহে নও’ মাসিকপত্রের সম্পাদক ছিলেন। ওই বছরেরই শেষদিকে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে লন্ডন যান। সম্মেলনে Bengali Folksong নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করে মনসুরউদ্দীন সবার প্রশংসা অর্জন করেন। ওই সম্মেলনে ফোকলোর বিশেষজ্ঞ হিসেবে গণ্য হওয়ায় তাকে International Folksongs Council-এর সদস্যপদ প্রদান করা হয়। লন্ডন থেকে ফিরে ওই বছরই তিনি ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

মনসুরউদ্দীন লোকসাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় প্রবন্ধ রচনা করে ‘ভারতী’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বিচিত্র’, ‘মোহাম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তার অক্ষয় কীর্তি হলো হারামণি। এর মোট ১৩ খণ্ডে লোকসংগীত সংকলন ও সম্পাদনা করে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। প্রতিটি খণ্ডের সম্পাদনায় তিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গভীর পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। মনসুরউদ্দীনের জীবনাবসান ঘটে ১৯৮৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর।