বাসস
  ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:০৬
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ২১:৪২

শিল্পী হিসেবে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় জায়গা হলো বিস্মিত হতে পারা: মুনেম ওয়াসিফ

আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): শিল্পী হিসেবে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় জায়গা হলো বিস্মিত হতে পারা। জীবনের যে খুঁটিনাটি ছোটখাট তুচ্ছ ব্যাপার আছে তার ভেতরেই যে আসলে এই জীবনের মর্মার্থ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পারা।

কথাগুলো বলছিলেন, ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে দৃশ্যশিল্প নিয়ে কাজ করা আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফ।

‘ক্রমশ’ শীর্ষক মুনেম ওয়াসিফের একক দৃশ্যশিল্প প্রদর্শনীর শুরু হয়েছে ১৮ এপ্রিল। দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত এ প্রদর্শনী চলবে ৩১ মে শনিবার প্রতিদিন বিকেল ৪ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত।

কার্যক্রম ও জীবনের উপলব্ধি নিয়ে মুনেম ওয়াসিফ বলেন, ঢাকায় এতো জায়গা থেকে পুরান ঢাকা কেন, তা আসলে বলতে পারবো না। পুরান ঢাকায় সাত/আট বছর ছিলাম। পুরান ঢাকার প্রতি আমার প্যাশনটা ছোটবেলা থেকেই। আমি আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস ও জহিরের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। সাহিত্যের একটা অনুগল্পও আছে এর পেছনে।

তিনি বলেন, প্রদর্শনীতে পুরান ঢাকা নিয়ে নানা ধরনের ছবি স্থান পেয়েছে। পুরান ঢাকা এমন একটা জায়গা যেখানে প্রতিদিন গেলেও অবাক হতে হয়। মানুষের জীবনের যে প্রাণ তা আসলে এতো বছর পর পুরানো ঢাকায় গেলে তা আমাকে ছুঁয়ে যায়। এই পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করে অনুপ্রাণিত হয়ে পুরান ঢাকাকে নিয়ে কাজ করেছি।

দৃশ্যশিল্প নিয়ে কেন কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মাধ্যমটায় কাজ করেছি, এটা ভালো লেগেছে এবং এর মাধ্যমেই আমি আমার জীবনকে বেছে নিয়েছি। ফলে আলাদাভাবে যে বেছে নিয়েছি তা নয়, নানা মাধ্যমে চেষ্টা করতে করতে এটা হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘ক্রমশ’ বইটি প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে চারজন লেখকের লেখা রয়েছে আমার কাজগুলো নিয়ে। অন্য বইটি ২০১২ সালে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। সেখানে আমার বারো বছর ধরে তোলা সাদাকালো ছবিগুলো স্থান পেয়েছে। এটি প্রকাশ করেছে প্যারিসের আন্তর্জাতিক একটি পাবলিশার্স। তারা বিশ্বের মানুষের পড়ার জন্য ইংরেজি ভাষায় পুরান ঢাকা সম্পর্কে জানাতে বইটি প্রকাশ করেছে। মুনেমের ইচ্ছে রয়েছে দেশের পাঠকের জন্য বাংলা ভাষায় বইটি অনুবাদ করার।

২০২৩ সালে, বাংলায় নীল চাষের ইতিহাস নিয়ে কাজ করার জন্য ওয়াসিফ রবার্ট গার্ডেনার ফেলোশিপ পান। নীল চাষ নিয়ে মুনেম বলেন, আমি অনেকদিন থেকেই নীল চাষ নিয়ে কাজ করছি। গতবছর আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীল চাষের ইতিহাসের ওপর কাজ করার জন্য একটা অনুদান পেয়েছি। সেই বিষয়টাকে নিয়ে গবেষণা করছি। ভবিষ্যতে সেসব বিষয় নিয়েও প্রদর্শনী হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পিবডি মিউজিয়াম অব আর্কিওলজি অ্যান্ড এথনোলজি’ থেকে তিনি সম্মানসূচক এই ফেলোশিপ পেয়েছেন। এই ফেলোশিপে তাঁকে বাংলাদেশি প্রায় ৫৪ লাখ টাকা বৃত্তি দেওয়া হবে। মুনেম ওয়াসিফই প্রথম বাংলাদেশি আলোকচিত্রী, যিনি এ সম্মান অর্জন করলেন।

‘ক্রমশ’ শীর্ষক মুনেম ওয়াসিফের একক দৃশ্যশিল্প প্রদর্শনী থেকে তোলা ছবি। বাসস

মুনেম ওয়াসিফ জানান, এই ফেলোশিপ তিনি তাঁর ‘নীল’ শিরোনামের শিল্পকর্মের জন্য ব্যবহার করবেন। তাঁর মতে, এটি বাংলার নীল চাষের পর্যালোচনামূলক ইতিহাসের বহুমাত্রিক বয়ান।

তার কাজ প্রায়শই আলোকচিত্র, চলমান ছবি, আর্কাইভাল ডকুমেন্টস এবং সংগৃহীত নানা সামগ্রীর সমন্বয়ে ক্ষণস্থায়ীত্ব ও নিরাপত্তাহীনতা বিষয়ক ভাবনা নিয়ে অনুসন্ধান করে। তার কর্মপন্থা দীর্ঘমেয়াদি এবং পুনরাবৃত্তিক, যা উপস্থাপন করে বহুস্তরীয়, সংবেদী এবং কখনো স্ববিরোধী উপলব্ধি।

মুনেম ওয়াসিফের উপস্থাপিত ছবিগুলো পুরান ঢাকার জীবনের গল্প বলে চলে। তার ছবির বয়ানে বলা হয়, ‘ক্রমশ’ আলোকচিত্র, ফিল্ম ও ভাস্কর্যের মিশ্র মাধ্যমে তিনটি পর্বে সাজানো-অন্তর্গত, সামান্য ও খেয়াল। আবার সেইসঙ্গে তিন ধরনের সময়ের দিকে কাজটি ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়, যার কোনো নির্দিষ্ট গতিপথ বা গন্তব্য নেই। অতীত, বর্তমান থেকে কল্পিত ভবিষ্যতে দিকে যেতে যেতে। সময়ের একাধিক স্তর এই প্রক্রিয়ায় ধরা পড়ে। মাঝপথে বিরতিতে সময়গুলো কেনো এক স্থানে দম নেয়। এবং ক্রমশ তারা একে অপরের সীমানা অতিক্রম করে যায়-ক্রমশ’তে।

তার ‘অন্তর্গত’, সামান্য, খেয়াল নানা সময়ের কথা বলে। ওয়াসিফের কাজ সেন্টার পম্পি দু, প্যালে ডি টোকিও, ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট মিউজিয়াম, মিউজি দে এলিসি, ঢাকা আর্ট সামিট, ছবি মেলা এবং শারজাহ, সিঙ্গাপুর, তাইপে, গোয়াংজু, দিরিয়াহ, লিয়ন বিয়েনালে প্রদর্শিত হয়েছে।

অন্যদিকে বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী মুনেম ওয়াসিফের প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে বিলঙ্গিং ক্লেমেন্টাইন (দে লা ফেরোনিয়ার, ২০১৩) এবং সল্ট ওয়াটার টিয়ার্স (ইমেজেস পুরিয়েলস, ২০১১) এবং তানজিম ওহাবের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় আলোকচিত্র বিষয়ক বাংলা ভাষার প্রবন্ধ সংকলন-কামরা-যার দুটি সংস্করণ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০২০-২০২১ সালে জার্মানির উইসেনশ্যাফটস্কোলেগ জু বার্লিনে ফেলো ছিলেন। একই সঙ্গে মুনেম পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং ২০১৫ সাল থেকে ছবি মেলার কো-কিউরেটর হিসেবে কাজ করছেন।

উল্লেখ্য, মুনেম ওয়াসিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে এবং পরবর্তীতে পাঠশালায় আলোকচিত্র নিয়ে শিক্ষা অর্জন করেছেন।