শিরোনাম
ভুবন রায় নিখিল
নীলফামারী, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : কুংফু-কারাত অনেকে শিখেন শখের বসে। আবার অনেকে শিখেন শারিরীক ব্যায়াম এবং কোন আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু একজন নারীর কারাত শিখে সেটিকে জীবনের অবলম্বন হিসেবে বেছে নেওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। এমন অসম্ভবকে জয় করে কারাতের সিঁড়ি বেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সেই যুবতীর নাম গায়েত্রী রানী রায় (২৫)।
গায়ত্রী কারাতের নানা ধাপ অতিক্রম করে অর্জন করেছেন ব্লাক বেল্ট উপাধি। তিনি এখন কারাতের একজন প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষক। বিভিন্ন স্কুল কলেজের মেয়েদের প্রশিক্ষণ প্রদানের আয়ে করেছেন নিজের ভাগ্য বদল। গড়ে তুলেছেন ধ্রুব কারাতে একাডেমি নামে প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত তিনি প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন অন্তত সাত সহস্রাধিক মেয়েকে। এসব প্রশিক্ষণার্থীর যেমন বেড়েছে নিজেকে গড়ে তুলার আত্মবিশ্বাস। তাদের (প্রশিক্ষণার্থী) মধ্যে অনেকেই প্রশিক্ষক হয়ে নতুনদের করাচ্ছেন প্রশিক্ষণ।
কারাতের এ প্রশিক্ষক গায়েত্রী রানী রায়ের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার মীরগঞ্জ ইউনিয়নের নিজপাড়া গ্রামে। তাকে আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছতে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক বাধা। ২০১৩ সাল, তখন তার বয়স ১২ বছর। পড়ছিলেন সপ্তম শ্রেণিতে। এসময় মারা যায় বাবা। তিন বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে সে মেজ। বড় বোনের বিয়ের পর হঠাৎ একদিন তাদেরকে ছেড়ে চলে যায় মা। এরপর ছোট এক ভাই আর বোনকে নিয়ে পড়েন ঘোর অন্ধকারে। এমন অবস্থায় ইউএসএস নামে একটি এনজিও পারিচালিত শিশু ফোরামের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ওই শিশু ফোরাম তাকে যোগায় পথ চলার সাহস। সে সাহসে ২০১৬ সালে সংস্থা কতৃক পরিচালিত মেয়েদের কারাতের ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি।
গায়েত্রী জানায়, ওই প্রশিক্ষণ পথ চলার মানসিক শক্তি জোগায় তার। এরপর ভাবতে শিখে নিজের এবং পরিবারের ছোট ভাই-বোনের জীবন নিয়ে। আগ্রহ বাড়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের। সে আগ্রহে রংপুর, ঢাকাসহ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিভিন্ন স্থানে। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশপাশি পরিবার ও নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের নিয়ে শুরু করেন কারাতে প্রশিক্ষণ। লেখাপড়া চালিয়ে ২০২৩ সালে নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে দর্শণ বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। প্রশিক্ষণ পরিচালনার আয়ে সে সময়ের দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া বোন পূর্নিমা রানী রায়কে লেখাপড়া করান এইচএসসি পর্যন্ত। এখন পূর্নিমা চাকুরী করছেন স্থানীয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর দেড় বছরের ছোটভাই ধ্রুব রায় এখন পড়ছে এইচএসসিতে। গায়ত্রী এসময়ে কারাতের অর্জন করেছেন স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের একাধিক পুরস্কার। এখন তার লক্ষ্য কারাতের গ্রা- মাস্টার হওয়ার।
গায়েত্রী জানায়, ওই প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতি মাসে তার আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। দীর্ঘ এ সময়ে ৩৩৫ কোর্সে প্রশিক্ষণ দিয়েছে অন্তত সাত হাজার মেয়েকে। প্রশিক্ষণের এসব ছাত্রী সমাজের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেকে রক্ষাসহ জীবনকে বুঝতে পারছে তার মতো করে।
গায়েত্রীকে আজ শনিবার দেখা গেছে জেলা শহরের টেনিস ক্লাব মাঠে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে। সপ্তাহের শুক্র এবং শনিবার বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন তিনি। চার বছর মেয়াদে চলতি ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ৩০ জন।
সেখানে কথা হয় প্রশিক্ষণার্থী চতুর্থ শ্রেণির আন্তা আক্তার, নবম শ্রেণির শতরূপা রায়, দশম শ্রেণির যুক্তি সিংহ, সপ্তম শ্রেণির নুসরাৎ আরা চৌধুরী, দশম শ্রেণির তনুশ্রী রায় লাবন্যের সঙ্গে। তারা জানান, স্কুলে যাওয়া আসাসহ বিভিন্ন স্থানে চলাফেরায় মেয়েদেরকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। কারাত প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে তারা সে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে চায়। প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।