বাসস
  ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬

‘আইডিয়া পিঠা পার্ক’ তরুণদের এক অনন্য সামাজিক উদ্যোগ

আইডিয়া পিঠা পার্কে খাচ্ছেন ক্রেতারা। ছবি : বাসস

।। মো. সাইফুল ইসলাম ।।

যশোর, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ (বাসস): ‘আইডিয়া পিঠা পার্ক’ কেবল একটি পিঠার দোকান নয়। এটি একটি অনন্য সামাজিক উদ্যোগ। এর মাধ্যমে দেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠা জনপ্রিয় করে তোলার পাশাপাশি দেশের বাইরেও সরবরাহ করা যাচ্ছে। অন্যদিকে এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডও। 

দেশের ঐতিহ্য শত রকমের পিঠাকে দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় করে তোলার চিন্তা থেকেই আইডিয়ার জন্ম। এই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সংকল্পবদ্ধ হন যশোর সরকারি এমএম কলেজের একজন শিক্ষক ও তার কয়েকজন ছাত্রী ।

‘আইডিয়া’র আইডিয়াটা প্রথম আসে এমএম কলেজের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীনের মাথায়। আর তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেন একই কলেজের শিক্ষার্থী সোমা খান, নাবিলা সুলতানা দিশা, তানজিয়া জাহান মমতাজ ও জান্নাতুল ফেরদৌস। ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর যশোর শহরের খড়কী এলাকার নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে যাত্রা শুরু হয় ‘আইডিয়া পিঠা পার্ক’-এর। শুরু থেকেই স্বাদ ও মানের দিক থেকে আইডিয়া’র পিঠা যশোরের মানুষের মন জয় করেছে।

উদ্যোক্তাদের সততা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠায় সাত বছরেই প্রতিষ্ঠানটি অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে।  

যশোরের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এখন আইডিয়ার বৈচিত্র্যময় পিঠার দেখা পাওয়া যায়। আগে এসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকম ফাস্ট ফুড সরবরাহ করা হতো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনেকেই পরিবারসহ পিঠা পার্কে গিয়ে নানা রকমের পিঠার স্বাদ নেন। অনেকে আবার পরিবারের জন্য পিঠা বানিয়ে নিয়ে যান। প্রবাসীরা পিঠার অর্ডার দিলে পিঠা বানিয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও আছে।

যেসব পিঠার চাহিদা বেশি

আইডিয়া পিঠা পার্কে এখন ১৩০ রকমের পিঠা তৈরি করা হয়। ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন পিঠার চাহিদা কম-বেশি হয়। আবার করোনার সময় আইডিয়া পিঠা পার্কের কর্মীরা ‘ইমিউনিটি পিঠা’ নামে একটি পিঠা তৈরি করে সাড়া ফেলেছিলেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এই পিঠার অর্ডার আসতো সারাদেশ থেকে। শীতের ভাপা, পুলি, চিতই, খেজুর রসে ভেজানো পিঠার পাশাপাশি হৃদয় হরণ, পাকান, লবঙ্গ লতিকা, ছিটারুটি, পাটিশাপটা, সবজি পিঠা, ভাজা পুলি, সিদ্ধ পুলি, সবজি লতিকা, ঝাল পাকান, চিকেন পুলি, মাছ পিঠা, দোসা পিঠা, চিকেন পাটিসাপটা, দোলন, গাজর ভাপা, নাড়ু, বাঁশ কাবাবসহ দেশের নানা প্রান্তের নানা স্বাদের ১৩০ রকমের পিঠা নিয়মিত তৈরি হয় আইডিয়াতে। 

কোথায় পাবেন, কীভাবে পাবেন

আইডিয়া পিঠা পার্কের রেস্টুরেন্টে বসেই শুধু নয়, দেশের যেকোন প্রান্তে বসেই তাদের পিঠা খাওয়া সম্ভব। এমনকি প্রবাসীরাও নিতে পারেন আইডিয়ার পিঠা । পিঠা যদি গরম গরম খেতে চান তাহলে চলে যেতে হবে যশোরের শাহ আবদুল করিম রোডে ‘আইডিয়া পিঠা পার্ক’ রেস্টুরেন্টে। তবে সবার পক্ষে তো যশোর যাওয়া সম্ভব নয়। তাই হোম ডেলিভারিও নিতে পারেন এই লিংকে https://www.facebook.com/share/19rwbCtgma/?mibextid=wwXIfr  অর্ডার করে। 

শিক্ষার্থীদের স্বনির্ভরতায় আইডিয়া

আইডিয়ার চার উদ্যোক্তা সোমা খান, নাবিলা সুলতানা দিশা, তানজিয়া জাহান মমতাজ ও জান্নাতুল ফেরদৌস যশোর সরকারি এমএম কলেজের শিক্ষার্থী। তাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিচ্ছেন তাদেরই শিক্ষক অধ্যাপক হামিদুল হক। উদ্যোক্তা চারজনের মধ্যে সোমা খান, তানজিয়া ও জান্নাতুল ফেরদৌসের মাস্টার্স শেষ হয়েছে। নাবিলা অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। দিশা জানান, আইডিয়াতে বর্তমানে ১১০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এরমধ্যে একশ’জনই শিক্ষার্থী, যারা প্রতিমাসে গড়ে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। 

আইডিয়ার সমাজসেবা

আইডিয়া পিঠা পার্কের সাথে জড়িত হয়ে একশ’ শিক্ষার্থী যেমন তাদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে পারছেন, পাশাপাশি পিঠা পার্কের লভ্যাংশের ৩৫ শতাংশ সমাজ সেবায় ব্যয় হয়ে থাকে। ‘ফ্রাইডে মিল’ কর্মসূচির আওতায়  আইডিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রতি শুক্রবার নিজেদের রান্না করা পোলাও, মাংস, ডিম, খিচুরি, বিরিয়ানি দু:স্থ মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসেন। 

এ ছাড়াও অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ, দরীদ্রদের গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া, নলকূপ স্থাপন আইডিয়ার একটা নিয়মিত কাজ। প্রত্যেক রজমান মাসে আইডিয়া ‘লস প্রজেক্ট’ নামে একটি কর্মসূচি করে থাকে। বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজারমূল্যে কিনে সেগুলো অনেক কমদামে দরীদ্রদের মাঝে বিক্রি করেন। গত কয়েকবছর ধরে তারা এই কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করে আসছেন। যা বেশ ভাল সাড়া ফেলেছে।

আইডিয়ার আরও উদ্যোগ

বাংলাদেশ পিঠা গবেষণা ইন্সটিটিউট 

শত রকমের পিঠা তৈরি ও বিক্রিতেই থেমে থাকেনি আইডিয়া। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার আনাচে-কানাচে এক সময় যে হাজারো রকমের পিঠার প্রচলন ছিল। সেগুলোর বেশিরভাগই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। হাজারো রকমের পিঠার তথ্য সংগ্রহ, সেগুলোর রেসিপি নিয়ে বই তৈরি ও গবেষণার জন্য আইডিয়ার তত্ত্বাবধানে ২০২৩ সালে ‘বাংলাদেশ পিঠা গবেষণা ইন্সটিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন তারা। ইতিমধ্যে এই ইন্সটিটিউট থেকে পিঠা বিষয়ক প্রায় ১০০টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

যুব কর্মসংস্থান

যুবকদের কর্মসংস্থান উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আইডিয়া যুব উন্নয়ন কেন্দ্র, খেলাচ্ছলে ইংরেজি শেখানোর জন্য ‘আইডিয়া স্পোকেন-দ্য গেইম মেথড’, বাংলাদেশ শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তা গ্রুপ (উইনি) অনলাইন ও অফলাইনে আইডিয়ার সাতটি অঙ্গসংগঠন রয়েছে। এসব অঙ্গ সংগঠনের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আইডিয়ার সাথে জড়িত বলে জানান আইডিয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা তানজিয়া জাহান মমতাজ।

‘আইডিয়া’র ইংরেজি শেখার সহযোগী সংগঠন ‘আইডিয়া স্পোকেন-দ্যা গেম মেথড’-এর কর্মী অনিন্দা পাঠক বলেন, ‘আইডিয়াতে এসে আমার শুধু কর্মসংস্থানই হয়নি, শিখেছি বহুকিছু। এখানকার সবগুলো অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে আমি প্রতিনিয়ত দক্ষতা অর্জন করছি, জানছি নতুন নতুন বিষয়। ভবিষ্যতে নতুন যে কোন কাজে এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারবো’। 

আইডিয়ার কর্মী নাবিলা সুলতানা দিশা বলেন, ‘আইডিয়ার মূল সমন্বয়ক শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্ট। এখানে জড়িত হয়ে আমরা নিজেরা যেমন আয় করতে পারছি, তেমনি আমাদের মতো অনেক শিক্ষার্থী তাদের পড়ালেখার খরচ এখান থেকে জোগাড় করতে পারছেন।

গ্রাহকদের মতামত

একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সেলস ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম আইডিয়া পিঠা পার্কের নিয়মিত গ্রাহক । তিনি বলেন, ‘আমার ও আমার পরিবারের সবার পছন্দ আইডিয়ার পিঠা। শুধু তাই নয়, আমার কোম্পানির প্রতিটি অনুষ্ঠানেই আইডিয়ার পিঠা থাকে। কাউকে উপহার দেওয়ার জন্যও আমি এখানকার পিঠা নিয়ে যাই।’

আইডিয়া পিঠা পার্কের নিয়মিত গ্রাহক কাজী ইফতেখোর উদ্দীন বাসসকে বলেন, ‘আইডিয়া পিঠা পার্কের পিঠার ভ্যারাইটি সবার আগ্রহের অন্যতম কারণ। পছন্দ অনুযায়ী গরম, ঠান্ডা, ঝাল, মিষ্টি এমনকি জেলাভিত্তিক প্রচলিত পিঠাও এখানে পাওয়া যায়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানগুলোতেও নানারকমের পিঠা নেওয়া হয় আইডিয়া থেকে।’

যশোরের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল হাসান বলেন, দেশীয় ঐতিহ্যের পিঠা নিয়ে আইডিয়া’র এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে অসাধারণ। এর মাধ্যমে আয়

করে শিক্ষার্থীরা যেমন তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছেন, তাদের আয়ের একটা বড় অংশ আর্তমানবতার সেবার ব্যয় করছেন। তিনি বলেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্যের অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুডে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় ঐতিহ্যের নানারকম স্বাস্থ্যকর পিঠা যদি সহজলভ্য করা যায়, তাহলে মানুষ সেগুলো ভালোভাবেই গ্রহণ করবে।

এতে পিঠার ঐতিহ্য যেমন রক্ষা হবে, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, অস্বাস্থ্যকর ফাস্ট ফুডের পরিবর্তে মানুষ স্বাস্থ্যকর ভালো খাবার খেতে পারবে।

আইডিয়ার স্বপ্ন

আইডিয়ার উপদেষ্টা অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে আইডিয়া পিঠা পার্ক তাদের লক্ষ্যের দিকে আজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে দেশীয় ঐতিহ্যের হাজারো রকমের পিঠা কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া থেকে যেমন রক্ষা করা যাবে, তেমনি এ খাতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

আইডিয়া পিঠা পার্কের কো-অর্ডিনেটর সোমা খান বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ও যথাযথ মার্কেটিং করতে পারলে এ খাতে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব। দেশের মধ্যে থাকা সব বিদেশী ফাস্টফুডের দোকানের শোকেসগুলো অচিরেই দেশের ঐতিহ্যবাহী শতরকমের পিঠা দিয়ে পরিপূর্ণ থাকবে- এমন স্বপ্ন দেখেন আইডিয়ার প্রত্যেক কর্মী।