বাসস
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫২

মৃতশিশু জন্মানোর হার প্রতিরোধ সম্ভব

প্রতীকী ছবি। ফ্রিপিক

ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫(বাসস): মা হওয়ার উত্তেজনায় অনেক খুশি ছিলেন মৃদুলা। কিন্তু সন্তান জন্মের দুই ঘণ্টা আগে তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। মিথিলা (৩১) একটি মৃত শিশু প্রসব করেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, যেকোনো কারণে হঠাৎ রক্তক্ষরণ হলে এবং চিকিৎসা পেতে দেরি হলে মৃতশিশু জন্মাতে পারে। এমনকি মায়েরও প্রাণ চলে যায়। তাই সাবধান থাকা প্রয়োজন। 

মৃতশিশু জন্মানোর কারণ সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, ‘মৃতশিশু জন্মানোর অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু অভ্যন্তরীণ, কিছু রয়েছে গর্ভকালীন জটিলতা। সাধারণভাবে বলতে গেলে, মায়ের পেটে ভ্রুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক থাকা প্রয়োজন। এ জন্য গর্ভবতী মায়ের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, হিমোগ্লোবিন, অ্যালবুমিন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ভ্রুণের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং এসব কারণে মৃতশিশু জন্মানোর ঝুঁকি বাড়ে। প্রসবের পূর্বে মায়ের কোনো কারণে রক্তক্ষরণ হলে, প্রি-একলাম্পশিয়া, ভাইরাল ইনফেকশন বা প্রসবের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে কিংবা প্রসবের সময় প্রয়োজনীয় সাপোর্ট না থাকলে মৃতশিশু জন্মাতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জরায়ুতে পানির মধ্যে শিশু থাকে। সেখানে অনেক সময় পানি কম থাকে বা পানি ভেঙে পড়ে যায়। সেক্ষেত্রেও জন্মানোর আগেই শিশু পেটে মারা যেতে পারে। এখনও আমাদের দেশে শতকরা ৪৮ ভাগ ডেলিভারি বাড়িতে হয়। এতে নানা জটিলতা তৈরি হয় এবং এভাবেও মৃতশিশু জন্মাতে দেখা যায়। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ডেলিভারি করা ঠিক নয়।’

মৃতশিশু জন্মানোর কারণ অনুসন্ধান এবং তা প্রতিরোধের জন্য সম্প্রতি সরকার এবং ইউনিসেফ একসাথে কাজ করছে। মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘ইউনিসেফ’-এর কৈশোর ও মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু সাদত মো. সায়েম বলেন, ‘আগে মৃতশিশু জন্মানোর বিষয়টি রেকর্ড হতো না। চলতি বছর থেকে এটা রেকর্ড হচ্ছে। মূলত দুটি কারণে এটা রেকর্ড হতো না। এক. কুসংস্কার এবং দুই. মৃতশিশু জন্মালে ওই মা এবং তার পরিবারকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না। সমাজে তারা নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত হন। এ জন্য অনেক সময় মৃত শিশু জন্মালেও তা স্বীকার করা হতো না। বলা হতো শিশুটি জন্মের পরপরই মারা গেছে, কিংবা জন্মের পর কিছুক্ষণ বেঁচে ছিল, সে শ্বাস নিয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে পরে মারা গেছে। ফলে শিশুটির মৃত্যু নবজাতকের মৃত্যু হিসেবে রেকর্ড হতো।’

তবে দ্রুত চিত্র বদলাচ্ছে। সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আজিজুল আলীম। তিনি বলেন, ‘ম্যাটারনাল অ্যান্ড পেরিনেটাল ডেথ সার্ভিলেন্স অ্যান্ড রেসপন্স (এমপিডিএসআর)- কর্মসূচিতে বর্তমানে মৃতশিশুর বিষয়টি যোগ করা হয়েছে। এটি এখন ৪৮টি জেলায় কাজ করছে। শিগগিরই তা ৬৪টি জেলায় কার্যকর হবে। জেলা, থানা এমনকি কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়েও মৃতশিশু জন্মালে তার কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে একটি নির্দিষ্ট ফরমেট পূরণ করে জাতীয় পর্যায়ে তা পাঠানো হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে মৃতশিশু জন্মানোর এই হার ১০-১২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ চলছে। যা এসজিডির সাথে যুক্ত হবে।’

তিনি আরো বলেন, “সন্তান নেওয়ার আগে একজন মায়ের পূর্ব প্রস্তুতিও প্রয়োজন। এ জন্য আমরা কাউন্সিলিংয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকার এটি গ্রাম পর্যায়েও শুরুর কথা ভাবছে। মৃতশিশু জন্মানো প্রতিরোধের জন্য সরকার ‘প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি’ বাড়ানো এবং ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ’কেও গুরুত্ব দিচ্ছে।’

তবে সচেতনতার বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ডা. ফারহানাও কাউন্সিলিয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এতে মায়েরা আগে থেকে সচেতন হতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন বলে তিনি জানান। 

তিনি বলেন, ‘এটা শুধু গর্ভবতী মায়ের একার বিষয় নয়। এর সাথে জড়িত বহু বিষয়। এটা প্রতিরোধ করতে হলে গর্ভকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। অবশ্যই নিয়ম অনুযায়ী চেকআপ করতে হবে এবং বাড়িতে ডেলিভারি না করে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে এবং এসব প্রতিষ্ঠানে ডেলিভারির প্রয়োজনীয় সাপোর্ট থাকতে হবে। তাই এ বিষয়ে পরিবার এবং সরকারকে যত্নশীল হতে হবে।’

সর্বোপরি, গর্ভবতী মায়ের সচেতনতা এবং পরিবার ও সরকারের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মৃতশিশু জন্মানোর হারকে রুখে দেয়া সম্ভব বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট সকলে। 

এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার গুরুত্বের কথাও তারা তুলে ধরেন।