বাসস
  ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৪৫

নানান সঙ্কটে বিপর্যস্ত বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

বাউফল ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ছবি: বাসস

// মো. এনামুল হক //

পটুয়াখালী, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): জেলার  বাউফল ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে নানান সঙ্কট। ২১ জন চিকিৎসকের জায়গায় বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১০ জন চিকিৎসক। এছাড়া পর্যাপ্ত ঔষধ না থাকা, আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারীদের বেতন না পাওয়াসহ খাবার মান ও হাসপাতালটির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ। ফলে চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

বাউফলের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছেন বৃদ্ধ আলাউদ্দীন কাজী (৭০)। তিনি খাবারের মান নিয়ে বলছেন, টানা পাঙ্গাস মাছ খাওয়াচ্ছে। মুরগির চেহারাও এক সপ্তাহে দেখিনি। তাছাড়া তরকারির মানও ভালো না। কোনো রকম খাচ্ছি।

নবজাতকের নিউমোনিয়া হওয়ায় হাসপাতালে শিশুকন্যাকে নিয়ে এসেছেন জাহিদ (২৭)। চার দিন ধরে ভর্তি আছেন তিনি। তিনি বলেন, সকালে ইনজেকশন দেয় না। মাঝেমধ্যে বাহির থেকে কেনা লাগে। এছাড়া ওষুধও বাইরের দোকান থেকে কিনেছি।

জাহিদ অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতাল থেকে রাতে দেয় দুপুরের তরকারি। খাবারের মান ভালো না। আর ক্লিনারদের ব্যবহার অনেক খারাপ। তবে তারা হাসপাতাল ঠিকঠাক ক্লিন করেন। কিন্তু আচরণ ভালো করলে ভালো লাগতো রোগীদের।

নিজের আড়াই বছরের মেয়ে রাফিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন মানসূরা (২০)। তিনি বলেন, আমি তিন দিন যাবত মেয়ে নিয়ে ভর্তি আছি। মেয়ের পায়ে বিচির মতো কি যেন উঠছে। পরে পা ফুলে গেছে। চিকিৎসার মান মোটামুটি ভালো। প্রথম দিন ইনজেকশন কিনে আনছি পরের দিন হাসপাতাল থেকে দিয়েছে।

খাবার নিয়ে মানসূরা বলেন, দুপুরে রুই মাছ আর শালগম দিয়েছে। রাতেও একই আইটেম। পরের দিন পাঙ্গাস আর শালগম দিয়েছে। আর সকালে একটি রুটি, একটি কলা আর একটি ডিম দিয়েছে। আমি এখানে আসার পর থেকে একদিনও মুরগি পাইনি।

পরিস্কার পরিচ্ছন্নের বিষয়ে মানসূরা জানান, দৈনিক তিনবার ফ্লোর মুছেন আয়ারা আর তিনবার ঝাড়ু দেওয়া হয়। এছাড়া নার্সদের সেবার মানও অনেক ভালো বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই।

এদিকে হাসপাতালে আউটসোর্সিং জনবলদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তারা হলেন শেফালি, শাহানাজ, ফিরোজ, মোহন, তাপস, শিখা, মিনতি ও টুম্পাসহ ১০ জন। তাদের অভিযোগ তারা নিয়মিত সঠিক সময়ে অফিসে এলেও তাদের বেতন হচ্ছে না প্রায় ১৩ মাস যাবত।

তারা কীভাবে এই হাসপাতালে চাকরি পেয়েছেন, জানতে চাইলে বাসসকে শাহানাজ জানান, নিয়োগ সার্কুলার হওয়ার পর ঢাকা গিয়ে চঞ্চল নামের একজনের কাছ থেকে যোগদান কার্ড নিয়েছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আমাদের তিন-থেকে চার হাজার টাকা দিতেন তা দিয়েই কোনোরকম চলতাম। তারপর আমরা করোনার সময়েও চাকরি করেছি।

‘তখন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা স্যার বলছিল যখন নিয়োগ হবে তখন তোমাদের কোনো টাকা লাগবে না। তোমরা প্রায়রোটি পাবা। কিন্তু যখন নিয়োগ সার্কুলার আসছে তখন আমাদের বাদ দিয়ে টাকা নিয়ে অন্য লোক নিতে চেয়েছে। পরে আমরা বলছি, টাকা যা লাগে দেব আমরা। তবুও আমাদের বাদ দিয়েন না। বাদ দিলে সংসার চালাতে পারবো না।’

তিনি আরও জানান, আমাদের জয়েনের পর ৬ মাসের বেতন দিয়েছে। ১৬ হাজার ৫০০ করে বেতন। এখন ১৩ মাস ধরে ১০ জনের বেতন পাচ্ছি না। কবে পাবো তাও জানি না।’

সরকারের কাছে আপনাদের কিছু বলার আছে, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহানাজ বলেন, ‘আমাদের দাবি সরকারই আমাদের না করুক।  আমরা গরিব মানুষ। আমরা বারবার টাকা দিয়ে খালি চাকরিতে জয়েন দেই। কিন্তু আমাদের কোনো গুরুত্ব দেয় না। কেউ দেড়লাখ, কেউ আড়াই লাখ, কেউ দুই লাখ টাকা দিয়ে আউটসোর্সিং জনবল হিসেবে আয়া পদে আমরা জয়েন করেছি।’

‘উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা (পিকে সাহা) স্যারের কাছে বেতনের জন্য গেলে স্যার বলে ঢাকায় যোগাযোগ করো। আর ঢাকায় যোগাযোগ করলে তারা বলে পিকে সাহা স্যারের সাথে যোগাযোগ করো। আমরা কারো কাছে সঠিক কথা পাই না।’ ১৩ মাস বেতন না হলেও প্রতিদিন সঠিক সময়ে হাসপাতালে সেবা দিতে আসেন বলেও জানান আয়া শাহনাজ।

হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় নাসির আহমেদ (৫২) বলেন, আয়া, ঝাড়ুদাররা ডিউটি ঠিকমত করে কিন্তু তারা বেতন পায় না। তাদের বেতনটা দেওয়া উচিত বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে বাসসকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, আমার হাসপাতালে জনবল ঘাটতি রয়েছে। তবে অন্যান্য উপজেলার তুলনায় আমরা ভালো আছি। ৫০ শয্যার হাসপাতালে ২১ জন চিকিৎসক থাকার কথা। কনসালটেন্ট ১০ জন থাকার কথা কিন্তু আটজন নেই। আর মেডিকেল অফিসার মোটামুটি আছে। হাসপাতালে ১৩ জন চিকিৎসক আছে। এরমধ্যে আবার ঝামেলা আছে। তিনজন আছে অ্যাটাসমেন্টে। তাহলে টোটাল হাসপাতালে ডাক্তার আছে মাত্র ১০ জন।

৫০ শয্যার হাসপাতালে মাত্র ১০ জন চিকিৎসক দিয়ে পরিপূর্ণ সেবা দেওয়া সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে  পিকে সাহা বলেন, সম্ভব না হলেও আমরা চেষ্টা করি পরিপূর্ণ সেবা দিতে।

তিনি আরও বলেন, ‘আয়া বা চতুর্থ শ্রেণির সংকট আমরা আউটসোর্সিং দিয়ে মিটিয়ে ফেলেছি। ক্লিনার পোস্ট ৪টি, জনবল আছে একটি। বাকিটা আউটসোর্সিং দিয়ে করে নিচ্ছি। তবে আমাদের স্টোর কিপার নাই। পরিসংখ্যানবিদ নাই। জরুরিভিত্তিতে আমাদের এই দুটো পোস্টে লোক দরকার। আর যে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে সেখানে লোক দরকার। মিনিমাম তিনজন অফিস সহায়ক জরুরিভাবে দরকার। এটা আউটসোর্সিংয়েও পাইনি।

পিকে সাহা বলেন, ‘আমাদের প্রধান সংকট হলো ডাক্তার। একজন নার্স কম আছে। সেটিও সম্ভবত পূর্ণ হয়ে যাবে।’

অপারেশন সেকশন চালু আছে কিনা জানতে চাইলে পিকে সাহা বলেন, আমাদের ওটি রেডি। মাঝখানে অপারেশন চালু হয়েছিলো। আমরা বাহির থেকে এনেস্থেশিয়ার ডাক্তার ধার করে এনেছিলাম। পরে আমাদের স্যার বললো, এভাবে তো বাহিরের এনেস্থেশিয়া দিয়ে কাজ করা যায় না। কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলে কি জবাব দিবা, তখন আমরা আবার  ওটি বন্ধ করে দিয়েছি। যদি আমাদের এখানে এনেস্থেশিয়া কনসালটেন্ট আসে আমরা তাকে নিয়ে কাজ করতে পারবো।

আপনি এই হাসপাতালে কত বছর যাবত আছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এই হাসপাতালে ৬ বছরের বেশি সময় ধরে আছি।

আর ওষুধের পর্যাপ্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমরা যে বরাদ্দ পাই তাতে ৫০ শতাংশও চাহিদা মেটে না। কারণ বরাদ্দের একটা লিমিট থাকে। যেমন এ বছর এক কোটি চার হাজার টাকার ওষুধ বরাদ্দ দিয়েছে। এরমধ্যে আবার ভ্যাট-ট্যাক্স আছে। তারপরে যে ওষুধ আমরা পাই তা দিয়ে সব রোগীকে আমরা সন্তুষ্ট করতে পারি না। তবে আমরা গরিব রোগীদের জন্য দামি ওষুধ রিজার্ভ রাখি। এটা সবাইকে দিতে পারি না। সবাইকে দিতে গেলে আমাদের ওষুধে হয় না।

খাবারের মান নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে কি বলবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পিকে সাহা জানান, খাবারের মান আগের চেয়ে ভালা হয়েছে। কেননা আগে ছিল তিন বেলা ১২৫ টাকা এখন হয়েছে ১৭৫ টাকা। এমনকি খাবারের মান আমার একজন মেডিকেল অফিসার প্রতিদিন তদারকি করেন।

নিয়ম হচ্ছে সপ্তাহে দু’দিন মুরগি দেবে কিন্তু আবাসিক রোগীদের অভিযোগ হচ্ছে, গত এক সপ্তাহে তারা মুরগি পায়নি। কীভাবে দেখছেন বিষয়টি, তিনি বলেন, আমি এখনই যারা খাবারের দায়িত্বে আছেন তাদের সাথে কথা বলছি। কেন তারা দিলো না।

আয়াদের অভিযোগ তারা বেতন পাচ্ছে না ১৩ মাস ধরে। তবে শিঘ্রই পাবে বলে জানিয়েছেন এই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, আমাদের এখানে বেশিরভাগ রোগী গরিব। সরকারি হাসপাতাল মনে করে তারা বাথরুমে পানিটা পর্যন্ত ঠিকমত দেয় না। আমার স্টাফরা কাজ করে। তারপরে তাদের মধ্যেও কিছুটা গাফেলতি আছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা দেখার জন্য নার্সিং সুপারভাইজার নিয়োগ করেছি। এ বিষয়ে আমরা মাসিক মিটিং করি। তারপরেও রোগীদের আরও সচেতন হওয়া উচিত।