বাসস
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:৩৩

ক্রমেই শিশুদের মধ্যে চশমার ব্যবহার বাড়ছে

প্রতীকী ছবি

ঢাকা, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : দীর্ঘ সময় ডিজিটাল স্ক্রিনে (পর্দায়) চোখ থাকায় দিনদিন শিশুদের দৃষ্টিশক্তি সমস্যা বাড়ছে। ফলে শিশুদের মধ্যে চশমা ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ অতিরিক্ত ডিভাইসের ব্যবহার।

চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের চোখে অতিরিক্ত স্ক্রিন অ্যাক্টিভিটি বড়দের চোখের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে। কারণ তাদের চোখ এখনো পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি। কোমল চোখে স্ক্রিনের আলো পড়লে সেটা সহজেই চোখকে আক্রান্ত করে।

রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী লিসা। দূরের জিনিস ঝাপসা দেখে। এ জন্য বাবার হাত ধরে চিকিৎসা নিতে এসেছে লিসা। লিসার বাবা হাসান ইমাম বলেন, ‘চার বছর বয়স থেকে মাইয়োপিয়া বা চোখের ক্ষীণদৃষ্টি রোগে ভুগছে লিসা। চিকিৎসকের কাছে নিলে ওর এই সমস্যা শনাক্ত হয়।

সাভার থেকে বাবার সঙ্গে এসেছে নিলয় (৯)। এক বছর আগেই তাকে চিকিৎসক চশমা ব্যবহার করতে বলেছেন। চোখে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ছেলেকে নিয়ে আবার চিকিৎসকের কাছে এসেছে বাবা ইসলাম ইকবাল। তিনি বলেন, ‘চশমা ছাড়া খালি চোখে আমার ছেলে এখন কিছুই দেখতে পায় না। অতিরিক্ত মোবাইল, টিভি, ট্যাব, ল্যাপটপ ব্যবহারের কারণে তার চোখের এই দশা হয়েছে।’

ইস্পহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের শিশু বর্হিবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স শামীম আরার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ৩শ’ থেকে ৪শ’ শিশু রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। শিশুদের অতিরিক্ত মোবাইল ও টিভি দেখার কারণে শিশুদের চোখের সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে বলেও মনে করেন তিনি। অন্যদিকে, ঢাকার শেরে বাংলা নগরের বাংলাদেশ চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন চিকিৎসা নেওয়া রোগীর শতকরা ৫০ ভাগই শিশু।

চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, মাত্রাতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে শিশুদের দৃষ্টি ক্ষীণ হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিশুদের দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে না। কারণ তারা বাইরের সবুজ প্রকৃতি কম দেখছে। দীর্ঘক্ষণ স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ আর টিভিসেটের সামনে থাকছে। শিশুদের দৃষ্টি ভালো রাখতে তাদের সবুজ দিগন্তে মেশার পরামর্শ দিয়ে ডা. নুজহাত আরও বলেন, শিশুরা কিছুক্ষণ বাইরে খেলবে, ছাদে যাবে, সবুজ দেখবে, পশু-পাখির সঙ্গেও সময় কাটাবে। এরপর একটা নির্দিষ্ট সময় তারা গেমও খেলবে। মোটকথা চোখকে বিরতি দিতে হবে। একটু ভিজতে দিতে হবে। নিয়ম করে অল্প সময়ের জন্য ডিভাইস বা টিভি দেখার সময় বেঁধে দিতে হবে, তাহলে শিশুর চোখ ভালো থাকবে।

২০২১ সালে ‘ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গবেষকরা ঢাকার প্রতি একশ’ শিশু শিক্ষার্থীর উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। সেই গবেষণায় প্রতি একশ’ মধ্যে প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থীর চোখেই সমস্যা রয়েছে বলে সনাক্ত করেন। হাসপাতালের শিশু চক্ষুরোগ ও স্কুইন্ট বিভাগের প্রধান মো. মোস্তফার নেতৃত্বে দলটি ঢাকার ১৯টি স্কুলের ছয় হাজার ৪০১ শিক্ষার্থীর চোখ পরীক্ষা করে। এর মধ্যে তিন শতাধিক শিশুর চোখে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন তারা। সেই শিশুদের প্রত্যেককে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এসব শিশু নার্সারি থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে এই হার কিছুটা কম।

ইস্পহানি ইসলামিয়া হাসপাতালের চিকিৎসক ড: ফরিদা জেসমিন বলেন, দীর্ঘক্ষণ চোখে চাপ পড়ায় বদলে যাচ্ছে শিশুদের চোখের মণির আকার। এর প্রধান কারণ ইলেকট্রনিক ডিভাইস মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। ভটিামনি ‘এ’-এর ঘাটতরি কারণে দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ হতে পারে বলেও জানান ডা. ফরিদা জেসমিন। শিশুদের ডিভাইস আসক্তির পেছনে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকা, লেখাপড়ার বাড়তি চাপ, সূর্যের আলোয় শিশুর না আসা, দিগন্তে সবুজের দিকে তাকিয়ে না থাকাকেই দায়ী করেছেন তিনি।

বুধবার সরেজমিন রাজধানীর মনিপুরী পাড়ার বাঁচা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির ২৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে চোখে চশমা ব্যবহার করছে। এদের একজন জোহান এই প্রতিবেদক বলেন, আমি তিন বছর ধরে চশমা ব্যবহার করছি। আরেকজন শিক্ষার্থী নীলয় বলে, আমি ব্ল্যাক বোর্ডের লেখা ঝাপসা দেখি। সে কারণে ডাক্তার আমাকে চশমা দিয়েছে। আমি আগে অনেক বেশি মোবাইলে গেমস খেলতাম। ডাক্তার নিষেধ করার পর এখন বেশি গেমস খেলি না। একই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিয়ান রহমানকে তার ক্লাস শিক্ষিকা চক্ষু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি তার বাবা মো. আরিফুর রহমানকে জানিয়েছেন, আরিয়ান ক্লাসে পেছনের সিটে বসলে ব্ল্যাক বোর্ডের লেখা কিছুই দেখতে পায় না।

ফার্মগেইট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের ১ম শ্রেণির ক্লাস শিক্ষিকা জেনি রোজারিও বলেন, বাচ্চাদের মোবাইল, ল্যাবটপসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ডিভাইসের হাত থেকে বাঁচাতে, ছেলেবেলা থেকেই তাদের ছবি আঁকা, গণিত শিক্ষা, নাচ, গান, লুডু, ক্রিকেট খেলাসহ নানা ধরনের খেলায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বাচ্চা যেটা শিখতে বা করতে আগ্রহী, তাকে সেটা করার সুযোগ দিতে হবে।

রাজধানীর শেরে বাংলা নগর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে শিশু চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আশিকুর রহমান আকন্দ বলেন, বর্তমানে বাবা-মায়েরা শিশুকে কোনো বিবেচনা ছাড়াই নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেন অথবা বিনোদনের জন্য ‘ট্যাব’ কিনে দেন। অবসর কিংবা পড়াশোনার ফাঁকে শিশুরা তাতে নানা ধরনের গেমস খেলে। দীর্ঘ সময় চোখ স্ক্রিনে রাখার ফলে স্ক্রিন থেকে আসা রশ্মি শিশুদের চোখের ক্ষতি করছে এবং চোখ স্থির হয়ে থাকার কারণে চোখ শুকনো হয়ে যায়। ফলে চোখের বিভিন্ন ত্রুটি দেখা দেয়। কোমল চোখে স্ক্রিনের আলো পড়লে সেটা সহজেই চোখকে আক্রান্ত করতে পারে। ফলে সে দূরের অথবা কাছের বস্তু ঝাপসা দেখে অথবা স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। এই রোগটাকে বলা হয় চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি সমস্যা। এই রোগে আক্রান্ত হলে পেছনের  বা দূরের কোনো জিনিসই স্পষ্ট দেখতে পায় না শিশুরা।