শিরোনাম
রেজাউল করিম মানিক
রংপুর, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : জনবল সংকটসহ নানা অব্যাবস্থাপনায় বেহাল দশায় জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো । ফলে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ উপজেলার চার লক্ষাধিক মানুষ। উপজেলা সদরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১৫ টি ইউনিয়নে ১৬ টি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৫৫ টি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকা সত্বেও স্বাস্থ্যসেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এ উপজেলার বাসিন্দারা।
পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক দপ্তর থেকে জানা যায়, ২০১১ সালে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। সে সময় আসবাবসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু জনবল সংকটসহ নানা কারণে বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
সরেজমিনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, শ্বাসকষ্ট ও ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিজ কাবিলপুরের সাজেদা ও শানেরহাটের আয়শা। মাথায় জ্বালাপোড়া ও ব্যথা নিয়ে সরলিয়ার কণিকাও ছিলেন অপেক্ষায়। তারা জানান, ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসক দেখানোর টিকিট পাননি। চিকিৎসক ও জনবলের অভাবে তাদের মতো সেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
শানেরহাটের ডায়াবেটিসের রোগী সালমা বেগম, রোগীর স্বজন জাহাঙ্গীর আলম ও খাদিজা বেগমের অভিযোগ, বহির্বিভাগে টিকিট কেটে দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পর চিকিৎসকের দেখা পেয়েছেন তারা।
হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা সংকটের কারণ অনুসন্ধানকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে নির্ধারিত জনবলের ৯৮ টি পদ শূন্য রয়েছে। এরমধ্যে পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২৩টি পদের বিপরীতে আছেন ১১ জন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন, গাইনি, শিশু, অর্থোপেডিক, কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞসহ ইএমও, আইএমও, সহকারী সার্জন ও দুই মেডিকেল অফিসার আছেন। কিন্তু জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), অ্যানেসথেশিওলজিস্ট, ফিজিক্যাল মেডিসিন, চক্ষু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞসহ সহকারী সার্জন, ডেন্টাল সার্জন, মেডিকেল অফিসার ও ইউনানি চিকিৎসক নেই।
এ হাসপাতলটিতে শুরুর দিকে গাইনি বিশেষজ্ঞ থাকায় সিজার হতো। কিন্তু ১৩ বছর ধরে এ সেবা বন্ধ রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০টি সিজার হলেও আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। এতে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা। এক সময় জরুরি প্রসূতি সেবার (ইওসি) আওতাভুক্ত ছিলো এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু এখন নেই। ফলে ৪৮ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয় রোগীদের।
উপজেলার ১৬ টি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকের ১৬ পদের বিপরীতে ১০ জন কর্মরত থাকলেও, বাস্তবে আছেন সাতজন। তিনজন ডেপুটেশনে অন্যত্র দায়িত্বে রয়েছেন। ৯ মেডিকেল অফিসার পদে চারজন এবং সাত সহকারী সার্জনের পদে আছেন তিনজন। জ্বালানি সংকটে অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যায় না। অথচ পীরগঞ্জসহ সাদুল্লাপুর, পলাশবাড়ী, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাটের রোগীও এখানে আসেন। এতে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক না থাকায় উপজেলায় ভিড় বেশি। ২০২৩ সালে মাদারগঞ্জ ও খালাশপীরে ১০ শয্যার মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র উদ্বোধনের পর ১৭ মাসেও চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ফলে বিপুল টাকা ব্যায়ে নির্মিত হাসপাতাল দুটি কোনো কাজে আসছে না।
বিভিন্ন হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদেরও অনেক পদ শূন্য রয়েছে। এরমধ্যে তিনটি ওয়ার্ডবয়ের পদ থাকলেও আছেন দু’জন। পাঁচজন এমএলএসএস-এর বিপরীতে তিনজন কর্মরত আছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট মেডিকেল অফিসারের ১০টি, দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, দুই ফার্মাসিস্ট, সহ-স্বাস্থ্য পরিদর্শকের সাতটি, স্বাস্থ্য পরিদর্শক তিনটি, অফিস সহায়ক আটটি, তিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দুই নিরাপত্তা প্রহরী, দুই বাবুর্চি, আয়া ও জুনিয়র মেকানিক।
রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও)সহ চারজন বাদে সবাই জেলা সদর থেকে যাতায়াত করেন। ৫৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ৫৪ জন সিএইচসিপি থাকলেও কাঙ্খিত সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
জনবল ও চিকিৎসক সংকটে রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাসুদ রানা বাসস কে বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর উপচে পড়া ভিড় থাকে। তাই এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা জরুরি। মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারীর ৫৫ পদের ৩৩টি শূন্য থাকায় ইপিআই কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। গাইনি চিকিৎসক থাকলেও অ্যানেসথেশিওলজিস্ট না থাকায় সিজার করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
চিকিৎসকদের কর্মস্থলে না থাকার বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি মাসুদ রানা। তিনি বলেন, আগে অস্ত্রোপচার হলেও এখন বন্ধ। টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে জটিল রোগী প্রজেক্টরে দেখিয়ে ঢাকার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়। ১৫টি ইউনিয়নের ৫৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররাও এখন অনিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সহকারী সার্জন তারিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, রবি থেকে বৃহস্পতিবার বহির্বিভাগে ছয়শ থেকে সাতশ রোগী থাকেন। ভর্তি থাকেন আরো শতাধিক রোগী। প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না থাকায় বহু রোগীকে ওষুধ ছাড়া ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বিদায় করতে হয়। নিকটবর্তী হাসপাতালের চেয়ে সেবার মান ভালো হওয়ায় এখানে ভিড় বেশি।
তিনি প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, চিকিৎসক সংকট এবং বেশি রোগী আসায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। সেবিকাদের সেবা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। ভর্তি ২০ জন খাবার পেলেও মান ভালো না হওয়ায় অনেকে ফেলে দেন। অথচ খাবারের ঠিকাদার প্রতিদিন ৫০ জন হিসেবে বিল তুলছেন। অভিযোগ দিলে একে অন্যকে দায়ী করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মচারীর অভিযোগ, ওষুধ ও পথ্য সরবরাহে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফোন আসে। এতে কর্মকর্তারা হয়রানির শিকার হন। এগুলো বন্ধ হলে ওষুধ ও পথ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হবে।
পীরগঞ্জ নাগরিক কমিটি ও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারি এবং ব্যবসায়ী ফোরামের সভাপতি এনামুল হক বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও অধিকাংশ সময় ৯০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারাও চিকিৎসা নিতে আসেন। এতে প্রায়ই ওষুধ, স্যালাইনসহ বিভিন্ন সামগ্রীর সংকট দেখা দেয়। উপজেলার চার লক্ষাধিক মানুষের স্বার্থে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।