বাসস
  ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:১৮

বছরে ৯৪ হাজার শিশুর জীবন বাঁচায় টিকা

প্রতীকী ছবি ইউনিসেফ

ঢাকা, ২১ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)’র মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ শিশুর রোগে আক্রান্ত হওয়া কমেছে এবং ৯৪ হাজার শিশুমৃত্যু কমেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ। 

আজ সোমবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলরুমে বিশ্ব টিকাদান সপ্তাহ উদযাপন-২০২৫ কে সামনে রেখে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)’র সার্বিক তত্ত্বাবধানে ‘বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রমের সাফল্য, উদ্ভাবন, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’- শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় তিনি একথা জানান।  

এ সময় ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি ১৯৭৯ সালে শুরু হয়- যা শিশুদের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগের বিস্তার রোধ করার জন্য সরকারের নেয়া সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ১৯৮৫ সালে সারা দেশব্যাপী সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। ইপিআই একটি মূল্যবান বিনিয়োগ, যেখানে প্রতি ১ মার্কিন ডলার বিনিয়োগের জন্য ২৫ দশমিক ৪ মার্কিন ডলার লাভ হয়। ইপিআই কর্মসূচি ছয়টি রোগের জন্য টিকা দিয়ে শুরু হলেও, বর্তমানে ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে ১২টি রোগের বিরুদ্ধে ১০টি টিকা দেওয়া হয়। ইপিআই কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগে, রোগাক্রান্ত হয়ে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুহার ছিল ১৫১ জন- যা ২০২৪ এ ২১ জনে দাঁড়িয়েছে। শিশু মৃত্যুহার কমেছে ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী একটি সফল উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত এবং বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। এর জন্য বাংলাদেশ গ্যাভি থেকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ উপাধি অর্জন করেছে। 
তিনি আরও বলেন, আগামী ২৪ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব টিকাদান সপ্তাহ, ২০২৫। গত ৫০ বছরে টিকার মাধ্যমে আমরা অনেক রোগ নির্মূল করেছি। পোলিও ও হামের মতো ভয়ানক রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছি। ১৯৭৪ সাল থেকে টিকা প্রতি মিনিটে ৬ জন শিশুর জীবন বাঁচিয়ে চলেছে। গত ৫০ বছরে বিশ্বব্যাপী টিকা ১৫৪ মিলিয়নের বেশি জীবন রক্ষা করে চলেছে। 

বাংলাদেশে  টিকাপ্রাপ্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে  টিকাপ্রাপ্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৮৫ সালে মাত্র দুই শতাংশ শিশু টিকা নেয়। ১৯৯১ সালে ৫২ শতাংশ।  ২০১৯ সালে বেড়ে ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ টিকা নেয়। তবে, ২০২৩ সালে সেটি কমে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।  

শহরের তুলনায় গ্রামের শিশুরা বেশি টিকা নিচ্ছে বলে তিনি জানান।  

২০১৯ সালে গ্রামে ৮৫ শতাংশ শিশু টিকা গ্রহণ করে। যেখানে শহরে গ্রহণ করেছে ৭৯ দশমিক দুই শতাংশ। ২০২৩ সালে গ্রামে ৮৪ দশমিক ছয় শতাংশ শিশু টিকা গ্রহণ করে। যেখানে শহরে করেছে ৭৯ শতাংশ। সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিকা গ্রহণ করেছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের শিশুরা।  

টিকাদান কর্মসূচির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, সম্প্রতি সারা দেশে সফলভাবে এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি সমাপ্ত হয়েছে এবং ৯৩ শতাংশ কভারেজ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়েছে। এরই মাধ্যমে এইচপিভি টিকাকে ২০২৫ সাল থেকে ইপিআই কর্মসূচিতে যোগ করা হয়েছে। এ বছর সম্ভাব্য আগস্ট মাস থেকে টাইফয়েড প্রতিরোধে টিসিভি টিকা ক্যাম্পেইন শুরু হতে যাচ্ছে, যা ৯ মাস বয়সী শিশু থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া হবে। গত ১২ বছর ধরে টিকাদান কভারেজ ৮৪ শতাংশের ওপরে উঠেনি। এছাড়া এই ১২ বছরে টিকাদান কভারেজ বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কভারেজ ইভ্যালুয়েশন সার্ভে ২০২৪ অনুসারে বর্তমানে ফুল ভ্যাকসিন কভারেজ ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ, যা কভারেজ ইভ্যালুয়েশন সার্ভে ২০১৯ এর থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। টিকাদান প্রকল্পে বরাদ্দকৃত জনবলের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ পদ এখনও শূন্য রয়েছে। ইপিআই সদর দপ্তর এ শূন্য পদের হার ৪৩ শতাংশ। টিকাদান কর্মসূচি সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য বাজেট বরাদ্দে দেরি হচ্ছে। বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থার ভিত্তিতে টিকাদান কেন্দ্র ও কর্মীদের সুষ্ঠু বণ্টন নেই। বিশেষ করে দুর্গম ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যে সংখ্যায় টিকাদান কেন্দ্র ও কর্মী থাকা দরকার, সেই সংখ্যক টিকাদান কেন্দ্র ও কর্মী নেই। 

নগরে টিকাদানে কোন কৌশল ও নির্দিষ্ট জনবল জনবল নেই, যার ফলে সঠিকভাবে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। 

টিকাদানের আওতায় জনগণের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ না হওয়ায়, টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও অর্জনে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয় এবং টিকা বরাদ্দে সমস্যা সৃষ্টি করে। 

জনশুমারীতে প্রাপ্ত এক বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ইপিআই মাইক্রো প্ল্যানের চেয়ে প্রায় ১০ লক্ষ কম। টিকাদান কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষ তদারকি ও পর্যবেক্ষণের অভাব থাকার কারণে টিকার অপচয়, টিকা না পাওয়া শিশু ও ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

টিকাদান কার্যক্রমে সমস্যা সমাধানে তিনি বলেন, আমাদের টিকার টার্গেট কাভারেজ অর্জন করতে হলে, বর্তমান স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করে পিছিয়ে পড়া এলাকা ভিত্তিক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে কর্মসূচী পরিচালনা করতে হবে। টিকাদান প্রকল্পে বরাদ্দকৃত জনবলের মধ্যে যে সকল শুন্যপদ রয়েছে সেখানে জরুরিভিত্তিতে জনবল নিয়োগ দিতে হবে।  
টিকাদান কর্মসূচি সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সময়মতো ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যাতে প্রতিটি টিকাদান কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায় এবং কোন স্থানেই টিকার অভাব না হয়। 

সিটি কর্পোরেশনগুলোতে নতুন অর্গানোগ্রাম ও সরকারি টিকাদানকর্মী প্রয়োজন। আরবান ইমিউনাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী, ১২টি সিটি কর্পোরেশনএ নিয়মিত কর্মী হিসেবে ১,৬৫৭ জন ভ্যাক্সিনেটর ও ৭৬৭ জন সুপারভাইজর নিয়োগ করা প্রয়োজন। নগরে টিকাদান কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত কৌশল তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যার ফলে সকল শিশুকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়। ইপিআই কর্মসূচিতে ব্যবহৃত সকল উদ্ভাবন (ই-ট্র্যাকার, ভ্যাক্সইপিআই, জিআইএস ভিত্তিক মাইক্রোপ্লান, ই-ভিএলএমআইএস/ ভ্যাক্সআইএন) সম্প্রসারণ করতে হবে এবং সরকারি তহবিলের মাধ্যমে চালু রাখতে হবে। টিকাদান কর্মীদের টিকাদান সম্পর্কিত নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সঠিকভাবে টিকাদানকারী ও জনগণের মধ্যে পারস্পারিক যোগাযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণকে টিকাদানে সচেতন করতে হবে। টিকাদান কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষ তদারকি ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে টিকার অপচয়, টিকা না পাওয়া শিশু ও ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা কমিয়ে টিকাদান কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করা যায়। সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে (বিশেষ করে শহরের টিকাদান কর্মসূচিতে) কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার  ডা. আবুল ফজল, মো. সাহাবুদ্দিন খান এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন পরিচালিত গবেষণা প্রকল্পের পলিসি অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।