শিরোনাম
গাজা স্ট্রিপ, ফিলিস্তিনি অঞ্চল, ৮ নভেম্বর, ২০২৩ (বাসস ডেস্ক): হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েলের স্থল অভিযান বুধবার দ্বিতীয় মাসে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতির আহবান সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজায় ধ্বংসাত্মক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনী গাজা শহরে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাসের সাথে লড়াইরত।
হামাসকে ধ্বংস করতে ইসরায়েলের সংকল্পের উপর জোর দিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গাজাকে ‘এখন পর্যন্ত নির্মিত বৃহত্তম সন্ত্রাসী ঘাঁটি’ বলে বর্ণনা করেছেন। মঙ্গলবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গাজা শহরের কেন্দ্রস্থলে আছি।
গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরায়েলের নিরলস বোমাবর্ষণে ১০,৩০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু।
যুদ্ধ থামানোর আহ্বান উপেক্ষা করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, হামাসের হাতে আটক ২৪০ জনেরও বেশি জিম্মিকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত কোনও বিরতি হনো।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বলেছেন, গত মাসটি ছিল ‘হত্যাকান্ড, নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভোগ, রক্তপাত, ধ্বংস, ক্ষোভ ও হতাশা’।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় নিহতদের স্মরণে মঙ্গলবার রাতে জেরুজালেমে ইসরায়েলিরা মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক পালন করেছে। হামাসের ওই হামলায় ১৪০০ ইসরায়েলি মারা যায়।
হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল গাজায় ধ্বংসাত্মক বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় গাজাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ গাজায় ভয়ঙ্কর স্থল অভিযান শুরু করে। গাজায় ১৫ লাখের বেশী মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল গাজার বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ সহ সকল জরুরি সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
পুরো শহরের ব্লকগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে এবং হাসপাতালের বাইরে সাদা কাফনের মৃতদেহ জমা হচ্ছে, যেখানে সার্জনরা মেবাইল ফোনের আলোতে রক্তাক্ত মেঝেতে কাজ করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ১৬০ শিশু নিহত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডমেয়ার বলেছেন, ‘মৃত্যু এবং কষ্টের মাত্রা বোঝা কঠিন।’
হামাসের মিডিয়া অফিস টেলিগ্রামে বলেছে, গাজার বেশ কয়েকটি কবরস্থানে ‘দাফনের জন্য আর জায়গা নেই’, অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় (ওসিএইচএ) বলেছে, অঞ্চলটির বেশিরভাগ স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশন বন্ধ রয়েছে।
ওসিএইচএ বলেছে, ইসরায়েল উত্তর গাজায় এখনও চালু ১৩টি হাসপাতালকে রোগীদের সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
নেতানিয়াহু বলেছেন, অবরুদ্ধ গাজায় কোনো জ্বালানি সরবরাহ করা হবে না, তবে জিম্মিদের মুক্ত করতে এবং সহায়তা প্রদানের জন্য সম্ভাব্য ‘কৌশলগত বিরতি’ দিতে পারে।
ওয়াশিংটন গাজার দীর্ঘমেয়াদী দখলের বিরোধিতা করার পর নেতানিয়াহুর বক্তব্য “তার দেশ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে গাজায় ‘সামগ্রিক নিরাপত্তা’ গ্রহণ করবে” এমন বক্তব্য থেকে ইসরায়েল পিছিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, ‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল ফিলিস্তিনিদের এই সিদ্ধান্তগুলো সামনে থাকতে হবে এবং গাজা হল ফিলিস্তিনি ভূমি এবং এটি ফিলিস্তিনি ভূমিই থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে বলতে গেলে, আমরা গাজা পুনর্দখলকে সমর্থন করি না এবং ইসরায়েলও চাইবে না।’
ইসরায়েলের কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রী এবং নেতানিয়াহুর যুদ্ধ মন্ত্রিসভার অংশ রন ডার্মার বিবিসিকে বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা পুনরুদ্ধার করবে না, তবে তারা যাকে হুমকি হিসেবে দেখবে তার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অভিযান চালাবে।
ইসরায়েল ২০০৫ সালে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে দখলকৃত এলাকা থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে।
রোববার অধিকৃত পশ্চিম তীরে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন পরামর্শ দিয়েছেন যে, ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অধীনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা উচিত।
ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষ শুধুমাত্র পশ্চিম তীরের কিছু অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসন অনুশীলন করে এবং আব্বাস বলেছিলেন যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের জন্য একটি ‘বিস্তৃত রাজনৈতিক সমাধান’ পাওয়া গেলেই এটি গাজায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে।
হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গাজি হামাদ এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে আল-জাজিরা আরবিকে বলেছেন, জঙ্গিরা ‘জাতীয় ফিলিস্তিন ফ্যাব্রিকের অংশ’।
তিনি বলেন, ‘ইরাক এবং আফগানিস্তানে ব্যর্থ হওয়ার পর, এখন আমেরিকানরা স্বপ্ন দেখছে যে তারা গাজাকে যেভাবে উপযুক্ত মনে করবে সেভাবে পুনর্বিন্যাস করতে পারবে।’
ব্লিঙ্কেন মধ্যপ্রাচ্য সফরের পর গাজা নিয়ে কূটনৈতিক সঙ্কটের একটি সাধারণ লাইন খোঁজার জন্য জি৭ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের জন্য জাপানে রয়েছেন।
মন্ত্রীরা গাজায় মার্কিন নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো থেকে বিরত থেকে ‘মানবিক বিরতির’ জন্য একটি যৌথ বিবৃতিতে আহ্বান জানাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মেডিকেল দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) বলেছে, বিশ্ব নেতারা অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ‘পুরো গাজা জুড়ে, অসহায় মানুষ তাদের পরিবারের সদস্য, বাড়িঘর এবং তাদের নিজের জীবন হারাচ্ছে, যখন বিশ্ব নেতারা অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
এমএসএফ এর বিবৃতিতে, কিভাবে সোমবার গাজার শাতি শরণার্থী শিবির এলাকায় বোমা হামলা চালিয়ে তাদের একজন কর্মী সদস্যকে তার পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা করেছে।
ইসরায়েল ১২,০০০ এরও বেশি বিমান ও কামান হামলার মাধ্যমে গাজাকে আঘাত করেছে এবং স্থল বাহিনী প্রেরণ করেছে যা কার্যকরভাবে গাজার অর্ধেক এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
গাজায় আকাশ থেকে ছড়িয়ে দেয়া লিফলেট এবং টেক্সট নির্দেশের মাধ্যমে উত্তর গাজার বেসামরিক নাগরিকদের দক্ষিণে পালানোর নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। তবে একজন মার্কিন কর্মকর্তা শনিবার বলেছেন, কমপক্ষে ৩৫০,০০০ বেসামরিক লোক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় রয়ে গেছে।
রেড ক্রসের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি বলেছে, গাজায় তাদের একটি মানবিক কনভয় মঙ্গলবার বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়েছে। সংস্থাটি বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগের অবসানের দাবি জানিয়েছে।
সংস্থার সভাপতি মিরজানা স্পোলজারিক বলেছেন, ‘শিশুদের তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও জিম্মি করা হয়েছে। গাজায়, আইসিআরসি সার্জনরা এমন বাচ্চাদের চিকিৎসা করেন যাদের ত্বক ব্যাপকভাবে পুড়ে গেছে।’
সামরিক বিশ্লেষকরা গাজায় সামনে কয়েক সপ্তাহের ঘরে ঘরে লড়াইয়ের বিষয়ে সতর্ক করেছেন, প্রায় ৩০ ইসরায়েলি সৈন্য ইতিমধ্যে আক্রমণে নিহত হয়েছে।
অপারেশনটি ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত জটিল, কারণ জিম্মিদের মধ্যে খুব অল্পবয়সী শিশু এবং দুর্বল বয়স্ক ব্যক্তিরা রয়েছে, যাদেরকে একটি বিশাল টানেল নেটওয়ার্কের মধ্যে রাখা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।