বাসস
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৩২
আপডেট  : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:১০

গলে যাচ্ছে হিমবাহ: মধ্য এশিয়ায় উদ্বেগ

ঢাকা, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস ডেস্ক): কিরগিজ পর্বতমালায় উঁচু একটি কাঠের কুঁড়েঘরের পাশে এক ধূসর পাথরের স্তূপের কাছে হেঁটে যান বিজ্ঞানী গুলবারা ওমোরোভা। মাত্র ক’বছর আগে এই স্থানটি যে একটি হিমবাহ ছিল তার স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
অ্যাডিজিন গ্লেসিয়ার থেকে এএফপি জানায়, ৩৫ বছর বয়সী এই গবেষক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার মিটার উচ্চতায় চীন, কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তাজুড়ে বিস্তৃত সুউচ্চ তিয়ান শান পর্বতমালার বিশাল বিশাল চূড়া পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
এই অঞ্চলটি হাজার হাজার হিমবাহের সূতিকাগার। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব হিমবাহ উদ্বেগজনক হারে গলে গেছে। ফলে ইতোমধ্যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত মধ্য এশিয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে।
এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হিমবাহবিজ্ঞানী ওমোরোভা। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর সাথে হিমবাহের অপসৃত হওয়ার প্রক্রিয়াটি রেকর্ড করছেন তিনি।
ছয় ঘণ্টা ধরে খাড়া পথ বেয়ে প্রায় মেঘলগ্ন ত্রিভুজাকৃতির কুঁড়েঘরে পৌঁছেন তিনি। এটিকে তিনি একটি বিজ্ঞানাগার হিসেবে ব্যবহার করেন।
ওমোরোভা বলেন, ‘আট থেকে ১০ বছর আগে এখানে তুষার ও হিমবাহ দেখা যেতো। কিন্তু গত তিন-চার বছরে এটি একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন কোনো তুষার নেই, নেই কোনো হিমবাহ।’ 


মধ্য এশিয়া বিশেষ করে উপর্যুপরি চরম আবহাওয়া বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি এ অঞ্চলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এখানকার বেশ কিছু স্থলবেষ্টিত অঞ্চল ইতোমধ্যেই মারাত্মক পানির ঘাটতি চলছে। তাই এ অঞ্চলের মানুষদের জন্য হাজার হাজার হিমবাহের গলে যাওয়া একটি বড় ধরনের হুমকিই বটে।
হিমবাহ এ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এখানকার জলাস্তম্ভ হিসাবে কাজ করে। আর এদিকে এখানকার অতিপ্রয়োজনীয় মিঠা পানির মজুদ এখন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

--‘সবকিছু পরিমাপ করা’--

ওমোরোভা একটি পরিমাপক যন্ত্র নিয়ে প্রখর রোদে ধূসর আবরণে ঢাকা বরফের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর গলিত জলের স্রোতের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন তিনি।
‘আমরা সবকিছু পরিমাপ করছি,’ তিনি বলেন। ‘তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলছে। ফলে পুনরায় হিমবাহ সৃষ্টি হতে পারে না।’
তিনি একটু এগিয়ে ছোট হয়ে আসা অ্যাডিজিন হিমবাহের দিকে ইশারা করেন। বলেন, এটি প্রতি বছর ‘প্রায় ১৬ সেন্টিমিটার (ছয় ইঞ্চি)’ হ্রাস পেয়েছে। ‘এটি ১৯৬০-এর দশক থেকে নয় শ’ মিটারেরও বেশি,’ তিনি বলেন।
এলাকার হাজার হাজার হিমবাহের অন্যতম এক সময়ের সমীহ-জাগানিয়া এ হিমবাহটি ধীরে ধীরে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে।
ইউরেশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুসারে গত ৬০ বছরে এশিয়ার দুটি প্রধান পর্বতশ্রেণী- তিয়ান-শান ও পামিরের ১৪ থেকে ৩০ শতাংশ হিমবাহ গলে গেছে।
ওমোরোভা সতর্ক করে দেন যে পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে।
‘গত বছরের তুলনায় গলে যাওয়ার হার অনেক বেশি,’ তিনি বলেন।


বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে ২০২৪ সাল সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড করতে পারে। ফলে ওমোরোভার মতো পেশার মানুষের কদর ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
কিন্তু সাবেক সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ কিরগিজস্তানে সম্পদের অভাব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওমোরোভা বলেন ‘আমাদের পরিমাপের সরঞ্জাম অপ্রতুল এবং আমাদের পর্যবেক্ষণ স্টেশনে জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই, নেই বিদ্যুৎ।’
তিনি আশা করেন যে কিরিগজ সরকার তুষারাবৃত বিশালাকার হিমবাহরাজি রক্ষায় একটি আইন প্রণয়ন করবে।

--বিপজ্জনক প্রবাহ--

হিমবাহ সঙ্কোচন কিরগিজ শহর ও নগরসমূহের জন্য একটি নতুন হুমকি তৈরি করেছে। এর ফলে প্রবল বেগে গড়িয়ে পড়া গলিত জলরাশি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বয়ে যাওয়ার আগে রাজধানী বিশেকসহ নানা স্থানে নতুন নতুন হ্রদ তৈরি করেছে।
উপত্যকার আরো নিচে- ২ হাজার ২০০ মিটার উঁচুতে পাহাড়ের ঘাসে ঢাকা অংশে- দুই বিজ্ঞানী সহোদর সের্গেই ও পাভেল ইয়েরোখিন, খরস্রোতা জলরাশির পাশ ঘেঁষে কাজ করছেন।
বড় ভাই, ৭২ বছর বয়সী সের্গেই, প্রবল স্রোতের তোড়ের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন।
তিনি বলেন, ‘এই জলস্রোত শিলা-পাথর বয়ে নিয়ে উপত্যকার নিচে প্রবাহিত হয় এবং শহর অব্দি পৌঁছে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, তাদের কাজ হলো জল-প্রবাহ পর্যবেক্ষণ এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা, যাতে মানুষ ও অবকাঠামো বিপজ্জনক এলাকায় না পড়ে। 
তার ভাই পাভেলের পানির প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে একটি সেন্সর ইনস্টল করা আছে, যেটি বন্যার সময় রেডিও সংকেত পাঠাতে সক্ষম।

-- ‘২০৫০ সালের মধ্যে অর্ধেক’ -- 

হিমবাহ গলতে থাকা কিরগিজ সরকারের জন্য অবকাঠামোর ক্ষতির চেয়ে বেশি হুমকিস্বরূপ।
এই অঞ্চলে সোভিয়েত যুগে পরিকল্পিত জলবণ্টন ব্যবস্থা কণ্টকাকীর্ণ সমস্যা হয়ে বিদ্যমান রয়েছে এবং এটি প্রতিবেশীদের মধ্যে ঘন ঘন উত্তেজনা সৃষ্টির উৎস হিসেবে ভূমিকা রাখে। 
ওমোরোভা জানান, পার্বত্য কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান প্রত্যেকে প্রায় ১০ হাজার হিমবাহের আঁতুড়ঘর। এগুলো মধ্য এশিয়ার তৃষ্ণা নিবারণে প্রধান জল-দায়িনী।
মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ জনসংখ্যার আবাসস্থল কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের কথা উল্লেখ করে ওমোরোভা বলেন, ‘আমরা আমাদের ভাটি অঞ্চলের প্রতিবেশীদের সাথে পানি ভাগাভাগি করি।
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার পাশাপাশি, হিমবাহগুলো আরেকটি হুমকির সম্মুখীন। সেটি হলো এই অঞ্চলে সোনাসহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী লোভ। রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে সোনা ইত্যাদি উত্তোলন বরফ গলে যাওয়া ত্বরান্বিত করে চলেছে।
কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান একটি আসন্ন বিপর্যয়ের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা জোরদার করেছে।
কিরগিজ প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ গত বছর সতর্ক করে দেন যে পূর্বাভাস মতে মধ্য এশিয়ার হিমবাহগুলো ‘২০৫০ সালের মধ্যে অর্ধেক হয়ে যাবে এবং ২১০০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাবে!’