শিরোনাম
প্যারিস, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪ (এএফপি) : রুয়ান্ডায় গণহত্যা চলাকালে জিন অলেয়ার কাইগিরবা তিন তিনবার নির্ঘাত মৃত্যুর মুখামুখি হয়েছিলেন। ঐ গণহত্যাযজ্ঞে জিনের বেশিরভাগ বন্ধু ও পরিবারের সদস্য হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল।
তুতসি জাতিগোষ্ঠীভূক্ত জিন ও তার বোন ছয় সপ্তাহ ধরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। সে সময় তাদের চারপাশে হত্যাকা- চলছিল। রুয়ান্ডার হুতু চরমপন্থীরা সেই সময়ে সংখ্যালঘু তুতসিদের নির্বিচারে হত্যা করছিল। জিন বলেন, ‘আমি জানি না, কিভাবে আমরা বেঁচে গেছি।’ তিনি সে সময়ের অনেক কিছুই মনে করতে চান না। তিনি বলেন, ‘তাহলে তো আমি চলতে পারব না।’ জিন বাঁচতে শিখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘তবে আপনি আপনার স্মৃতি থেকে একটি গণহত্যা মুছে ফেলতে পারবেন না। দুঃসহ স্মৃতিগুলো মনের কোঠায় বারবার ফিরে ফিরে আসে।’
‘যে খুনিরা আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, আমি কি তাদের আমার এই দ্বিতীয় জীবনও নষ্ট করতে দিব? না-কি আমি এই জীবনে বাঁচার চেষ্টা করবো?’ কথাগুলো বলছিলেন ৪৬ বছর বয়সী জিন অলেয়ার কাইগিরবা। তিনি পরবর্তীতে প্যারিসের একজন শীর্ষ স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা হয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে চরমপন্থী হুতু শাসননামলে সংগঠিত গণহত্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। সেবছরের এপ্রিল ও জুলাইয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু তুতসি পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের পরিকল্পিতভাবে নির্মূল করা হয়েছিল। হুতু বাহিনীর সদস্যরা এদের অনেককেই ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। হুতু বাহিনীর পাশাপাশি হুতু গোষ্ঠীভূক্ত প্রতিবেশী, সহকর্মী এমনকি বন্ধুরাও তাদের হত্যা করে।
ভয়াবহতার তিন দশক পর, এএফপি হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া এবং ফ্রান্সে দত্তক নেওয়া ও বেড়ে ওঠা তুতসি শিশুদের খুঁজে বের করার কাজ শুরু করে। তারা এই হত্যাযজ্ঞের নির্মমতা, অবিচার এবং আর স্বজন হারিয়ে বেঁচে থাকার অনুভূতির কথা বলেছিল। এদের কেউ কেউ বড় হয়ে বিদেশেই থেকে যায়। অন্যরা রুয়ান্ডায় ফিরে আসে।
জিন সেই হত্যাযজ্ঞে তার বাবা, বোন, বন্ধু, খালাতো-চাচাতো ভাইবোন, খালা ও চাচাকে হারিয়েছেন। দুঃসহ ওই দিনের স্মৃতি থেকে তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিহত আত্মীয়দের সংখ্যা গণনা করার চেষ্টা করি না। যেদিন তারা আমাদের হত্যা করতে এসেছিল, সেদিন তারা আমাদের মন্দিরে বন্দুক রেখেছিল।’
জিন বলেন, ‘আমাকে ফ্রান্সে গিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, আর এটি ছিল আমার জন্য যে কোন কিছুর চেয়েও বড় সাহায্য। এরফলে আমাকে প্রতিদিন খুনিদের দেখতে হতো না।’
দেশে আসার পরপরই জিন ইবুকা গ্রুপটির সংস্পর্শে এলেন। এটি গণহত্যার কবল থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদের দল। ইবুকা গণহত্যার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে নিবেদিত। গ্রুপের সদস্যরা স্কুলগুলোতে গিয়ে গণহত্যার সময় যা ঘটেছিল, তার বর্ণনা দেন।
জিন তার ‘দ্বিতীয় জীবনকে’ আঁকড়ে ধরেছিলেন। প্যারিসে তার পারিবারিক জীবন শুরু হয় এবং কর্মক্ষেত্রে তিনি নগরীটির মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমি অনুভব করি যে, গণহত্যা সম্পর্কে কথা বলে আমি সেই সব মৃতদের কথা বলছি, হত্যা করে যাদের চিরতরে নির্বাক করে দেওয়া হয়েছে।’
তবে মানজি রুগিরাঙ্গোগা’র চিত্রটি একটু ভিন্ন। মানজি শৈশবের স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে। মানজি শিশু বয়সে অকল্পনীয়ভাবে বেঁচে গেছেন। গণহত্যার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ মাস। তার পরিবার দক্ষিণের শহর বুটারে অন্যান্য তুতসিদের সাথে একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তীতে মানজি রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে ফিরে আসেন।
১৯৯৪ সালের ২৯ এপ্রিল হুতু মিলিশিয়ারা তাদের শহরে হামলা চালায়। তার মা, খালা ও চাচাকে একসাথে হত্যা করা হয়েছিল। তার মা তাকে পিঠে বেঁধে পালাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সে সময় তাকে, তার বোনকে এবং ভাইকে গুলি করা হয়নি। তার ভাই ও বোনের বয়স ছিল বয়স চার ও সাত বছর। তিনি বলেন, ‘তার মানে এই নয় যে, হত্যাকারীরা আমাদের রেহাই দিয়েছিল। তারা শুধু বলেছিল যে, তারা আমাদের মেরে তাদের গুলি নষ্ট করতে চায় না।’ সরাসরি গুলি করে হত্যার পরিবর্তে হত্যাকারীরা এই শিশুদের ‘ক্ষুধা ও দুঃখ-কষ্টে মারা যাওয়ার জন্য’ ছেড়ে দিয়েছিল। মানজির বাবা তিন মাস পর তাকে বুরুন্ডির একটি অনাথ আশ্রমে খুঁজে পান। সুইস দাতব্য সংস্থা টেরে দেস হোমস (টিডিএইচ) এর একটি অসাধারণ উদ্ধার অভিযানের কারণে এ শিশুরা বেঁচে গিয়েছিল।
গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ১,০০০ জনের মধ্যে একজন মানজি বলেন, ‘গণহত্যায় আমার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করা হয়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শুধু আমার বাবাই বেঁচে আছেন।’ মানজির বয়স এখন ৩১ বছর। মানজির বাবা একজন পশুচিকিৎসক। গণহত্যা চলাকালে তিনি একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ফ্রান্সে ছিলেন। মানজি বলেন, তার বাবা বাচ্চাদের ফ্রান্সে নিয়ে আসেন। রুয়ান্ডায় যা ঘটেছে, তা নিয়ে আমি এখনও এই বিশাল হত্যাযজ্ঞের কোন বিচার হয়নি বলে অনুভব করছি। মানুষ তাকে জিজ্ঞাস করত যে, তিনি কোথা থেকে এসেছেন। কিন্তু তিনি তার দেশ ও অতীত সম্পর্কে খুব কমই জানতেন।
১০ বছর বয়সে প্রথমবার রুয়ান্ডায় ঘুরে আসার পরই তিনি তার দেশে ফিরে যাওয়ার ‘একটি সহজাত প্রয়োজন’ অনুভব করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি শেষ পর্যন্ত জানতাম যে আমি কোথা থেকে এসেছি।’ কিশোর বয়সে কঠিন সময় পার করে মানজি ১৫ বছর বয়সে তার খালার সাথে কিগালিতে থাকার জন্য ফিরে যান। তারপরে সেখানে তিনি দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তাকে রুয়ান্ডান ভাষা শিখতে হয়েছিল। পরে ফ্রান্সে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সম্পন্ন করার পর, তিনি কিগালিতে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, ‘তখন আমি ফ্রান্সে আমার ভবিষ্যত দেখতে পাইনি।’
একই নীরবতায় বড় হয়েছেন স্যান্ড্রিন লরুসো। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। তিনি গণহত্যায় তার বাবা-মা ও তিন ভাইবোনকে হারিয়েছেন। ফ্রান্সে বসবাসকারী তার বড় বোন ও বোনের স্বামী তাকে দত্তক নেন। এএফপি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই কোমলভাষী দুই সন্তানের মা প্রথমবারের মতো কিগালিতে গণহত্যার ফলে তার কী অবস্থা হয়েছিল- সে সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। তিনি পেশায় একজন নার্স। তিনি বলেন, ‘হত্যাকারীরা আমাদের বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছিল। তারা আমার মাকে ধরে নিয়ে যায়। তবে তারা আমাকে ও আমার বোন অ্যালাইনকে রেখে গিয়েছিল। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের কাছে দৌড়ে পালিয়েছিলাম এবং কয়েক মিনিট পরেই আমরা গুলির আওয়াজ শুনতে পাই।’ একথা বলার সময় কান্নায় তার কণ্ঠ ভেঙ্গে যায়। সে এখনো জানে না যে, কিভাবে তার বাবা মারা গেছে। তাকে গণকবরে পাওয়া গেছে।
স্যান্ড্রিন লরুসো বলেন, বড় হয়ে আমার মস্তিষ্ক থেকে এই দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলতে আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু স্যান্ড্রিন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে জিনিসগুলি ‘জটিল’ হয়ে ওঠে। প্রথমবার অন্তসত্ত্বা হওয়ার সময় মানসিক আঘাতটি যেন প্রতিশোধ নিয়ে ফিরে এসেছিল। তিনি বলেন, ‘আমার দূঃসহ প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল। আপনি এটিকে যতই চেপে রাখার চেষ্টা করবেন, ততই এটি আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। আগে বা পরে কোন এক সময় এই দুঃসহ স্মৃতিগুলো ফিরে আসবেই।’
ফ্রান্সে চলে যাওয়ার সময় জিন ভেবেছিলেন, তিনি ‘গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতিগুলোও’ পিছনে ফেলে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম যে আমি একটি ভাল জীবনযাপন করতে যাচ্ছি। আমি আশা করেছিলাম যে আমাকে আর মানুষের হাড় ও বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষে দেখতে হবে না। কিন্তু আপনি যদি ৬,০০০ কিলোমিটার দূরেও চলে যান, তবুও আপনি আপনার সাথে গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আসবেন।’
গ্যাসপার্ড জোসেফের স্মৃতিও তার পিছু তাড়া করে বেড়ায়। ছয় বছর বয়সে তিনি গণহত্যা থেকে পাঁচ মাস একা বনে লুকিয়েছিলেন। প্যারিসের একটি ক্যাফেতে তিনি এএফপিকে বলেন, ‘(গণহত্যার পর) ৩০ বছরের স্মৃতিচারণ আমাকে তীব্রভাবে স্পর্শ করে এবং আমার সাথে কী ঘটেছে- সে সম্পর্কে আমি আমার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।’ গণহত্যার শুরুতে তার ছোট বোন ও মা’কে হুতু আত্মীয়রা বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। তার টুটসি গোত্রের মা তার হুতু গোত্রের বাবার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের ‘মিশ্র’ সন্তানের জন্য ভয় পেয়ে, তার বাবা তাকে বনে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলেন। তবে তিনি তাকে খুঁজতে আসতে পারেননি। কারণ তাকেও হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৯৪ সালের অক্টোবর, গণহত্যা শেষ হওয়ার তিন মাস পর ডমিনিক জাসেফ নামে একজন ফরাসী নার্স তাকে ক্ষুধার্ত ও মুমূর্ষু অবস্থায় বনে খুঁজে পান। ওই নার্স একটি স্থানীয় ডিসপেনসারিতে কাজ করছিলেন। গ্যাসপার্ড বলেন, ‘আমি লুকিয়ে থাকা অবস্থায় যা পেতাম তাই খেতাম। আমি ছোট প্রাণী শিকার করেছি। আমি গাছে থাকতাম। সেই অবস্থায় আমার দ্বিতীয় মা (সেই ফরাসী নার্স) আমাকে খুঁজে পান।’ তিনি আরো বলেন, চিকিৎসকরা ভেবেছিলেন ‘আমার বাঁচার কোন আশা নেই’। কিন্তু ফরাসি নার্স তাকে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি চিকিৎসা করেছিলেন। পরে ওই নার্স মা তাকে দত্তক নেন, তার জীবন পরিবর্তন করেন।
গ্যাসপার্ডের এখনও ঘুমাতে সমস্যা হয় এবং যেদিন তাকে তার মা এবং তার বোনকে কবর দিতে হয়েছিল, সেই দিনটি তাকে পীড়িত করেছিল। কিন্তু ‘আমার দুঃখময় জীবনের মধ্যেও আমি দু’জন খুব স্নেহময়ী মা পেয়েছি বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।’ প্রচ- মানসিক আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও, তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের জন্য বেশ কয়েক বছর কাজ করেন। তিনি ‘দ্য অ্যাডপ্টেড অফ রুয়ান্ডা’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার রক্ত ও আমার চামড়া রুয়ান্ডার। তবে নিজেকে আমি সম্পূর্ণ ফ্রেঞ্চ মনে করি।’ তবুও টুটসিদের গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। খুনি হুতু শাসনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত প্যারিস দীর্ঘদিন ধরে কিগালি গণহত্যায় ‘সন্ত্রাসের’ জন্য অভিযুক্ত ছিল।
গণহত্যার ৩০ তম বার্ষিকী বেঁচে থাকা অনেকের জন্য একটি বড় মুহূর্ত হয়েছে। গত বছর জিন তার স্বামী ও ছোট ছেলের সাথে রুয়ান্ডায় ফিরে আসেন। কিগালি থেকে এএফপিকে তিনি বলেন, ‘আমি অনুভব করছিলাম যে আমি ফ্রান্সের কিছু মিস করছি। আমি আবার আমার পরিবার এবং আমার মায়ের সাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। তার বয়স এখন ৮০ পেরিয়ে গেছে। আমি আমার ছেলেকে আমার মাতৃভূমি ও আমার ভাষা দেখাতে চেয়েছিলাম। হয়তো আমি আমার দেশকে পুনর্গঠনে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।’ গ্যাসপার্ড বলেছেন যে তিনি অবশেষে ‘স্থিতিশীলতার একটি রূপ’ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি তার গ্রামে ফিরে যেতে চান ও জানতে চান যে তার বাবার কী হয়েছিল।
কিগালিতে মানজির অনেক প্রকল্প রয়েছে। তিনি একটি ‘আফ্রিকান ভবিষ্যতবাদী’ উপন্যাস লিখেছেন, একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং মরিচ, মটরশুটি এবং তরমুজ চাষের খামারগুলিতে বিনিয়োগ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার শিকড়, আমার পরিবার ও আমার ইতিহাসের সাথে পুনরায় সংযোগ আমাকে আমার মানসিক কষ্ট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।’