শিরোনাম
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৫ (বাসস) : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর ও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রবার্ট এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথি প্রকাশ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এসব নথির মধ্যে আছে হত্যাকারী সিরহান সিরহানের হাতে লেখা কিছু নোট, যেখানে তিনি লিখেছেন, 'এই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে সরিয়ে ফেলতেই হবে' এবং কেনেডিকে হত্যা করার বিষয়ে নিজের ‘অদম্য উন্মত্ততা’র কথা স্বীকার করেছেন।
গত ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ট্রাম্প। দায়িত্ব নিয়েই তিনি একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছিলেন। ট্রাম্পের সেই আদেশে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, তার ভাই রবার্ট এফ কেনেডি এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র হত্যাকাণ্ড-সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা পেশ করতে ফেডারেল সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত মাসে ১৯৬৩ সালের বহুল আলোচিত ও রহস্যঘেরা জন এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রায় ৮০ হাজার পৃষ্ঠার নথি প্রকাশ করা হয়। এর এক মাসের মাথায় ১৯৬৮ সালের আরেক আলোচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে হাজারো নথি প্রকাশ করল ওয়াশিংটন।
১৯৬৮ সালের ৫ জুন লস অ্যাঞ্জেলেসের দ্য অ্যাম্বাসেডর হোটেলে রবার্ট এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় দলের প্রার্থী নির্বাচনে (প্রেসিডেনশিয়াল প্রাইমারি) নিজের বিজয় উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন রবার্ট এফ কেনেডি। তার হত্যাকারীর নাম সিরহান সিরহান। তাকে প্রথম-ডিগ্রির হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তিনি এখনও যাবজ্জীবন কারাভোগ করছেন।
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় গোপন তথ্য উন্মুক্ত করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, এই প্রকাশ তারই অংশ। এর এক মাস আগে ১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত অবিকৃত নথিপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল।
সেইসব নথিতে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের গোপন বৈদেশিক অভিযানের বিষয়ে আরও বিশদ তথ্য উঠে এলেও কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রচলিত ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পক্ষে তেমন কোনো নতুন তথ্য মেলেনি।
নতুন প্রকাশিত নথিগুলোর মধ্যে সিরহানের হাতে লেখা কিছু নোটের ছবি রয়েছে। একটি খালি খামের ওপরে লেখা ছিল: 'আরএফকে'কে অবশ্যই তার ভাইয়ের মতো সরিয়ে ফেলতে হবে।' এই খামের প্রেরকের ঠিকানায় ছিল লস অ্যাঞ্জেলেসের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগের জেলা পরিচালকের নাম।
আরও একটি পাতায়—যা পাসাডেনা সিটি কলেজের খাতার—সিরহান বারবার লিখেছেন: আরএফকে'কে অবশ্যই মরতে হবে' এবং 'আরএফকে'কে অবশ্যই খুন করতে হবে।'
১৮ মে ১৯৬৮ তারিখে লেখা একটি নোটে তিনি লিখেছেন: (আরএফকে'কে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমার সংকল্প এখন এক ধরনের দুর্দমনীয় নেশায় পরিণত হচ্ছে।'
এই নথিগুলো প্রকাশের ফলে হত্যাকাণ্ডের পেছনে সিরহানের উদ্দেশ্য ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে নতুন আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নতুন প্রকাশিত নথিগুলোর আরেকটিতে দেখা যায়, সিরহান বলেছিলেন তিনি :বর্তমান প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পক্ষে' মত দিয়েছেন। রবার্ট এফ কেনেডির মৃত্যুর সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাট লিন্ডন জনসন।
সিরহান লিখেছিলেন, 'আমার এখনও কোনো চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেই, তবে শিগগিরই তা তৈরি করব।' তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট রাশিয়া ও চীনের প্রতি সমর্থন জানান।
নথিগুলোতে সিরহানকে চেনা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাক্ষাৎকারের নোটও রয়েছে—যেমন সহপাঠী, প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা। কেউ কেউ তাকে 'বন্ধুবৎসল, সদয় ও উদার ব্যক্তি' হিসেবে বর্ণনা করেছেন, আবার কেউ তাঁকে দেখেছেন 'চিন্তান্ধ' ও সহজেই প্রভাবিত হয়—এমন এক তরুণ হিসেবে, যিনি রাজনীতির ব্যাপারে গভীরভাবে অনুভব করতেন এবং এক সময় ক্ষণিকের জন্য অতিলৌকিকতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন।
নথি অনুযায়ী, ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র হত্যাকাণ্ডের পরপরই সিরহান তার আবর্জনা সংগ্রহকারী সহকর্মীকে বলেন তিনি কেনেডিকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছেন।
ওই সহকর্মী ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তিনি তদন্তকারীদের জানান, তিনি কেনেডিকে ভোট দিতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন কেনেডি কৃষ্ণাঙ্গদের সাহায্য করবেন। এর জবাবে সিরহান বলেছিলেন, 'তোমার সঙ্গে আমি একমত নই। আমি ওই হারামজাদাকে গুলি করার পরিকল্পনা করছি।'
এফবিআই-এর নথিপত্রে বর্ণনা করা হয়েছে একদল পর্যটকের সাক্ষাৎকার, যারা রবার্ট এফ কেনেডির মৃত্যুর আগেই তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার গুজব শুনেছিলেন।
১৯৬৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল ভ্রমণকারী কয়েকজন পর্যটক জানান, সেখানে এক ট্যুর গাইড তাঁদের বলেছিলেন কেনেডি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। একজন জানান, তিনি শুনেছেন মিলওয়াকিতে কেনেডির ওপর হত্যাচেষ্টা হয়েছে। আরেকজন বলেন, তিনি শুনেছেন কেনেডিকে নেব্রাসকায় গুলি করা হয়েছে।
ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্প্রতি এসব নিয়ে ২২৯টি ফাইল নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত অনেক ফাইল আগে থেকেই প্রকাশিত ছিল, তবে অনেকগুলো এখনও ডিজিটাল রূপে আনা হয়নি এবং দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন সংরক্ষণাগারে পড়ে ছিল।
রিপাবলিকান দলের রাজনীতিক ডোনাল্ড ট্রাম্প গোপনীয়তা হ্রাস ও স্বচ্ছতার জন্য এসব হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ড ও তদন্ত-সংক্রান্ত নথি প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তবে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি সন্দিহান। তার প্রশাসনের এই গোপন নথি উন্মোচনের সিদ্ধান্তের ফলে সিআইএ ও এফবিআইয়ের কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে জনপর্যায়ে নতুন করে প্রশ্ন ও বিশ্লেষণের পথ খুলে গেছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন, যেখানে রবার্ট এফ কেনেডি ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত সব সরকারি নথি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। উভয় হত্যাকাণ্ড মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ঘটেছিল।
রবার্ট এফ কেনেডির হত্যাকারীর আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, সিরহান সমাজের জন্য আর কোনো ধরনের হুমকি বা বিপদ সৃষ্টি করবেন না এবং তিনি পুনরায় এমন অপরাধ করার সম্ভাবনাও রাখেন না।
২০২১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যারোল বোর্ড সিরহানকে মুক্তির উপযোগী বলে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু রাজ্যের গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম ২০২২ সালে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন এবং সিরহানকে কারাগারেই রাখেন। ২০২৩ সালে আরেকটি বোর্ড তার মুক্তির আবেদন আবারও খারিজ করে দেয়, যাতে লেখা ছিল: তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারেননি ঠিক কী কারণে তিনি কেনেডিকে গুলি করেছিলেন।
প্রয়াত সিনেটরের ছেলে রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালিকা তুলসি গ্যাবার্ডকে ‘সাহস’ ও ‘অবিচল প্রচেষ্টা’র জন্য প্রশংসা করেছেন, যাদের কারণে এসব নথি প্রকাশ সম্ভব হয়েছে।
এক বিবৃতিতে কেনেডি জুনিয়র বলেন, 'আরএফকে সম্পর্কিত নথিগুলোর ওপর থেকে পর্দা সরানো আমেরিকান সরকারের ওপর জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।'