শিরোনাম
ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : ফ্রন্টলাইনে লড়াইরত প্রেমিকের একটি খুদে বার্তা বা ফোনকলের অপেক্ষায় ফোনের স্ক্রিনে অপলক তাকিয়ে থাকেন ইউক্রেনীয় তরুণী কাতেরিনা হালুশকা। রুশ আগ্রাসনের ফলে হাজারো নারীর মতো তার ভালোবাসার গল্পও রূপ নিয়েছে অনিশ্চয়তায় ঠাসা এক অনন্ত প্রহর গোনার জীবনে।
কিয়েভ থেকে এএফপি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধ সমাপ্তির প্রতিশ্রুতিতে আস্থা হারানো হালুশকা বলছেন, তারা যেন আটকে আছেন এক ‘অপেক্ষার অলাতচক্রে’।
২৮ বছর বয়সী এই তরুণী বললেন, ‘আমার যেন এক নতুন সামাজিক পরিচয় তৈরি হয়েছে—আমি এখন সেই নারী, অপেক্ষা করাই যার কাজ।’
চুপচাপ বসে থাকা তার ধাতেই নেই। দুই জায়গায় চাকরি করেন, পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসাকর্মী হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। তবে একটি গুরুতর আঘাত পাওয়ার পর এখন আর সামনের সারিতে যেতে পারেন না।
‘এই অনন্ত অপেক্ষার মানসিক চাপ প্রচণ্ড... মনে হয় খারাপ কিছু ঘটছে। শুধু বসে থাকি, কখন ফোন আসবে বা মেসেজ আসবে সেই অপেক্ষায়,’ বললেন তিনি।
এর আগেও এক প্রেমিককে হারিয়েছেন যুদ্ধেই। তার বর্তমান প্রেমিক এক-দু’দিন যোগাযোগ না করলেই সেই বেদনা ফিরে আসে।
‘তাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে যেতে হয়—এবং প্রতিনিয়ত এই আশঙ্কা জাগে, সে হয়তো আর ফিরবে না। এমনও হতে পারে, তার মৃতদেহটাও আমরা কখনোই দেখব না।’
বাস্তবতার মুখোমুখি ভালোবাসা
‘মস্তিষ্ক কখনও ভালো কিছু কল্পনা করে না,’ বলেন হালুশকা। ‘মনে হয় না যে আমার প্রেমিক পুতিনকে গুলি করেছে বা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।’
ট্রাম্প এক সময় বলেছিলেন, তিনি ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ করতে পারেন। এখন তিনি একটি শান্তি চুক্তির কথা বলছেন, যার মাধ্যমে ইউক্রেনীয় সেনারা ঘরে ফিরতে পারবে—এমন সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল শুধু ইস্টার উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত একটি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন। তবে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে এখনো কোনো কার্যকর সমঝোতার ইঙ্গিত নেই।
‘চিরন্তন শান্তির স্বপ্ন দেখি, কিন্তু...’
ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ অঞ্চলে কর্মরত আরতুরের স্ত্রী দারিয়া ইয়েদামোভাও হতাশ। তিনি বলেন, ‘আমি চাই আরতুর ফিরে আসুক। চিরন্তন শান্তি চাই। কিন্তু আমরা তো বাস্তব জগতে বাস করি!'
ভিডিও কলে স্বামীর উচ্ছ্বাসভরা সমর্থন পেয়েই তিনি কিয়েভের নিজেদের ফ্ল্যাটে সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন—সঙ্গে দুই সন্তানকে সামলাচ্ছেন।
‘আমরা ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি গড়ছি,’ বলেন দারিয়া। কিন্তু যুদ্ধের শেষ দেখা না যাওয়ায় দীর্ঘ বিচ্ছেদ মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছে তাঁদের।
১১ মাস বয়সী কন্যা লিনা চট করে বাবাকে চিনতে পারে না। আরতুর মেয়ের জন্মের কয়েক মাস পরই যুদ্ধে যোগ দেন।
তাদের তিন বছর বয়সী ছেলে তারাস প্রায়ই বাবার কথা বলেই দিন কাটায়—‘বাবা আসবে’, ‘আমরা একসাথে ঘুমাব’, কিংবা ‘আমরা একসাথে বই পড়ব।’
ক্ষণিক দেখা, স্মৃতির স্বাদ
সেনাদের পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই দেশজুড়ে ভ্রমণ করে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে মিলিত হন।
হালুশকার প্রেমিক মাঝেমধ্যে ছুটিতে কিয়েভে আসার অনুমতি পান। তখন তারা পালন করেন একটি ছোট্ট রীতি—কিয়েভের এক ফুডকোর্টে গং পাও চিকেন খাওয়া, আর সঙ্গে গোলাপি আইসিং দেওয়া স্ট্রবেরি কেক।
এই সামান্য আনন্দের মুহূর্তগুলোই যেন ভবিষ্যতের অন্ধকারে আশার অমিয় আলো হয়ে থাকে।
ট্রাম্পের রুশপন্থী অবস্থানকে ঘিরে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। ট্রাম্প কিয়েভকে কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে চাপ দিচ্ছেন এবং ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ট্রাম্পের বিজয়কে ইউক্রেনের জন্য ‘খারাপ’ মনে করা নাগরিকের হার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ শতাংশে—তথ্য কিয়েভ ইনস্টিটিউট ফর সোসিওলজির।
হালুশকা বলেন, ‘আমাদের এমন কিছু বোকারামের বিষয়ে কথা বলতে হচ্ছে, যা আমাকে রাগিয়ে তোলে।’ তিনি বলেন, ট্রাম্প আর ইলন মাস্ক সম্ভবত জীবনে একটা ইতিহাস বইও খুলে দেখেননি।
‘রাশিয়া আবার আক্রমণ করবে—এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র, সম্ভাবনার নয়। তখন আমার প্রেমিকের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে,’ বলেন হালুশকা।