বাসস
  ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ২১:২৭

‘পাম দ’অর’ জয়ী স্লিয়েপচেভিচ : ক্রোয়েশিয়ার সাহসী নির্মাতা

ঢাকা, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : যুগোশ্লাভিয়ার পতনের সময়কার যুদ্ধের অন্ধকার ছায়া থেকে শুরু করে সামাজিক বর্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরতে পিছপা হন না ক্রোয়েশীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা নেবোইশা স্লিয়েপচেভিচ।

জাগরেব থেকে এএফপি জানায়, গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য ম্যান হু কুড নট রিমেইন সাইলেন্ট’ সিনেমার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘পাম দ’অর’ জিতেছেন তিনি।

বসনিয়ার এক যুদ্ধাপরাধ নিয়ে নির্মিত এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি এ বছর অস্কারেও শর্টলিস্ট হয়েছিল। এছাড়া এটি ফরাসি সিজার পুরস্কার ও ইউরোপীয় একাডেমি পুরস্কারসহ এক ডজনের বেশি সম্মাননা অর্জন করেছেন।

জাগরেব-জন্ম নেওয়া স্লিয়েপচেভিচ বলেন. ‘এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল... পুরস্কারের সংখ্যার বিচারে এটি ইতিহাসের অন্যতম সফল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে।’

ছবিটি ১৯৯৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, যখন সার্ব বাহিনী পূর্ব বসনিয়ার স্ত্র্পচি গ্রামে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন থামায়। সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর ১৯ জন মুসলিম যাত্রীকে অপহরণ করে পরে হত্যা করা হয়।

প্রায় ৫০০ যাত্রীর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত যুগোশ্লাভ সেনা কর্মকর্তা টোমো বুজভ ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি অপহরণকারীদের সামনে প্রতিবাদ করেছিলেন।

জাতিগতভাবে ক্রোয়াট বুজভকে অন্যদের সঙ্গে ধরে নেওয়া হয়। তার দেহাবশেষ, অন্যান্য অধিকাংশ ভুক্তভোগীর মতোই, আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

স্লিয়েপচেভিচ বলেন, ‘যদিও ছবিটি ১৯৯৩ সালের বসনিয়ার একটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে, কিন্তু এর বিষয়বস্তু সার্বজনীন এবং কাল-সীমাহীন।’

‘এটি এমন একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরে, যা আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ হিসেবে প্রায়ই হয়... আমরা অন্যায় বা সহিংসতার সাক্ষী, কিন্তু এমনভাবে দেখি যেন সেটি আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।’

ছবিটি এক ব্যতিক্রমী সাহসী মানুষকে শ্রদ্ধা জানায়, যিনি নিরীহ মানুষদের রক্ষার জন্য কেবল নিজের কথাকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন- বললেন ৫২ বছর বয়সী এই নির্মাতা।

বুজভের পরিবার বর্তমানে বসবাস করছে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে। ছবি নির্মাণের আগে তাদের অনুমতি নেন স্লিয়েপচেভিচ।

নিজেকে অন্তর্মুখী হিসেবে পরিচয় দেওয়া শান্ত স্বভাবের এই নির্মাতা মনে করেন, চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা তার ছবির সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, ‘এটি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা বলে। আজকের বিশ্ব অনেক বেশি সহিংস, স্ক্রিপ্ট লেখার সময় যা ছিল না। সহিংসতা এখন বিশ্বকে চিরতরে পাল্টে দিতে পারে।’

‘বৈশ্বিক ঘটনাবলি আমার ছবির সাফল্যের পক্ষে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে। এতে আমি কোনো বিজয়ের আনন্দ পাই না,’ যোগ করেন তিনি।

স্লিয়েপচেভিচ বলেন, তিনি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন, সেগুলো অবশ্যই তার কাছে আবেগগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি হতে হয়।

‘সামাজিকভাবে গুরুত্বহীন কোনো বিষয় নিয়ে এত ব্যয়বহুল ও বিশাল কিছু তৈরি করাটা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়,’ বলেন তিনি।

তার দুটি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রামাণ্যচিত্র—‘গ্যাংস্টার অব লাভ’ (২০১৩) ও ‘স্রবেনকা’ (২০১৮)— সমাজে ‘অন্যরকম’ মানুষদের, বিশেষত জাতিগত কারণে, বর্জনের চিত্র তুলে ধরে।

‘গ্যাংস্টার অব লাভ’-এ এক বুলগেরিয়ান একক মাকে ক্রোয়েশিয়ায় পাত্র খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন এক বিয়ের দালাল, যা রক্ষণশীল সমাজের জটিলতা ও রসবোধের মিশেলে উপস্থাপিত হয়।

ক্রোয়েশিয়ার গ্রামীণ ক্যাথলিকপ্রধান অঞ্চলে পুরুষেরা বিদেশি সন্তানসহ নারীদের বিয়ে করতে অনাগ্রহী।

‘স্রবেনকা’ ছবিটি তুলে ধরে ৯০-এর দশকের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও ক্রোয়েশিয়ায় জাতিগত টানাপোড়েন।

ছবিটি একটি নাট্যনির্ভর প্রামাণ্যচিত্র, যেখানে যুদ্ধের সময় ১২ বছর বয়সী এক সার্ব মেয়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে তৈরি মঞ্চনাটকে অংশ নেওয়া এক ক্রোয়াট মেয়ের মধ্যকার আতঙ্ক ফুটে ওঠে—শুধু জানার পর যে, সেও এক সার্ব বংশোদ্ভূত।

বর্তমানে স্লিয়েপচেভিচ কাজ করছেন ক্রোয়াট লেখক ক্রিশতিয়ান নোভাকের উপন্যাস ‘ডার্ক মাদার আর্থ’ অবলম্বনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে—যেখানে যুদ্ধকালীন শৈশবের স্মৃতিচারণায় মগ্ন এক লেখকের গল্প বলা হবে।

‘ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হবে স্কুলজীবনের সহপাঠী নির্যাতন ও সামাজিক বর্জনের চিত্র,’ বলেন তিনি।

‘আমি নিজেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি... তাই এই বিষয়টি আমার খুব ব্যক্তিগত মনে হয়।’

স্লিয়েপচেভিচ আশা করছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে তিনি ছবিটির কাজ শেষ করতে পারবেন।