বাসস
  ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪০

সাইগন পতনের ৫০ বছর: গ্র্যান্ড প্যারেডে চীনা সেনাদের অংশগ্রহণ

ঢাকা, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : সাইগনের পতনের ৫০ বছর পূর্তিতে বুধবার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উদযাপন আয়োজন করল ভিয়েতনাম। এবারই প্রথমবারের মতো এই অনুষ্ঠানে অংশ নিলে চীনা সেনারা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সদ্যসমাপ্ত সফরের পর এই পদক্ষেপকে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে।

হো চি মিন নগরী থেকে এএফপি জানায়, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সম্প্রচারে দেখা যায়, প্যারেড চলাকালে আকাশে উড়ছে যুদ্ধবিমান ও পতাকা বহনকারী হেলিকপ্টার। হো চি মিনের প্রতিকৃতি সম্বলিত একটি ভাসমান মঞ্চও ছিল নগরীর মিছিলে। হাজার হাজার মানুষ গায়ে ভিয়েতনামের পতাকার ছাপযুক্ত টি-শার্ট পড়ে রাস্তার পাশে সারি বেঁধে সারা রাত অপেক্ষায় ছিলেন এই প্রদর্শনী দেখার জন্য। শিশু থেকে প্রবীণ—সব বয়সী মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনামের ট্যাঙ্ক সাইগনের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ফটক ভেঙে ঢুকে পড়ে, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামকে পরাজিত করে এবং আমেরিকার নৈতিক ও সামরিক প্রভাবের ওপর গভীর আঘাত হানে।

৭৫ বছর বয়সী সাবেক যোদ্ধা ট্রান ভান ট্রুং বলেন, 'দক্ষিণকে মুক্ত করতে পেরে আমি গর্বিত।' হ্যানয় থেকে সামরিক পোশাক পরে তিনি এসেছেন প্যারেড দেখতে।

'তবে যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আমার কারও প্রতি ঘৃণা নেই,' বলেন তিনি। 'আমরা এখন একসঙ্গে যুদ্ধের অবসান উদযাপন করতে পারি।'

হো চি মিন নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ‘লে জুয়ান স্ট্রিট’ দিয়ে আনুমানিক ১৩,০০০ মানুষ—সাবেক সেনা, বর্তমানে কর্মরত সৈনিক এবং সাধারণ নাগরিক—এই প্যারেডে অংশ নেন।

এই প্রথমবারের মতো চীন, লাওস ও কম্বোডিয়ার ৩০০-এর বেশি সেনা এই আয়োজনে অংশ নেয়।

রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় প্রায় ৩ লক্ষাধিক চীনা সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে বিমান প্রতিরক্ষা, রসদ ও অন্যান্য লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করেছিল।

তবুও, এর আগে কখনও এত বড় পরিসরে কোনো স্মরণানুষ্ঠানে চীনা সেনাদের দেখা যায়নি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র চার বছর পর, চীন নিজেই ভিয়েতনামে হামলা চালিয়েছিল। তবে হ্যানয়ের সেনারা তাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছিল।

ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক অধ্যাপক জ্যাক আবুজা বলেন, 'আমার ধারণা, হ্যানয় চীনকে একটি বার্তা দিচ্ছে যে তারা চীনের ঐতিহাসিক অবদানকে স্বীকৃতি দেয়।'

'এটি একটি বার্তাও : ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি আমেরিকার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে না।'

১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল যুদ্ধের অবসান ঘটার পর, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনর্গঠন করে এখন শক্তিশালী বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে।

তবে ভিয়েতনাম একটি ‘বাঁশ কূটনীতি’ অনুসরণ করে, যার অর্থ তারা বেইজিং ও ওয়াশিংটন—উভয়ের সঙ্গেই ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়।

এই উদযাপন এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং চলতি মাসেই হ্যানয় সফর করেছেন। বেইজিং চাইছে নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে স্থিতিশীল অংশীদার হিসেবে তুলে ধরতে। কারণ, ভিয়েতনাম এখন ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত আমেরিকান শুল্কের হুমকির মুখে এবং বিভিন্ন সহায়তা কর্মসূচি হ্রাসের ফলে যুদ্ধ-সম্পর্কিত অনেক উদ্যোগ হুমকিতে পড়েছে।

পুনর্মিলন ও উৎসাহ  

দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো মানুষ প্রাণ হারায়, যার মধ্যে ছিল ৫৮ হাজার মার্কিন সেনাও। যুদ্ধ শেষে গোটা দেশজুড়ে কমিউনিস্ট শাসনের বিস্তার ঘটে।

দক্ষিণ ভিয়েতনামের বহু সরকারি কর্মচারী দেশত্যাগ করে, আর যারা রয়ে যায়, তাদের পাঠানো হয় ‘পুনঃশিক্ষণ শিবিরে’।

প্রথমদিকে এই বিজয় ছিল কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক বৈধতার প্রধান ভিত্তি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনমানের উন্নয়ন।

সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে পার্টির শীর্ষ নেতা তো লাম ব্যতিক্রমীভাবে ‘পুনর্মিলনের’ ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি লেখেন, 'ভিয়েতনামীদের হৃদয় থেকে ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজনের অনুভূতি দূর করতে হবে যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আর কখনও যুদ্ধ দেখতে না হয়।'

অধিকাংশ ভিয়েতনামী যুদ্ধোত্তর প্রজন্মের প্রতিনিধি হলেও, মঙ্গলবার রাত থেকেই রাস্তায় উৎসবের আমেজ দেখা যায়। কনসার্টের সুর আর আলোয় মুখর হয়ে ওঠে শহর।

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন গণমাধ্যমে প্যারেডের মহড়ার দৃশ্য সম্প্রচারের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়।

হো চি মিন নগরীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ছাত্র ১৯ বছর বয়সী থাং ডাং তাঁর ২৫০ সহপাঠীর সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও কমিউনিস্ট পার্টির হাতুড়ি-হাঁড়ির পতাকা নিয়ে প্যারেডে অংশ নেন।

তিনি বলেন, 'আমি আমার ভবিষ্যৎ সন্তানদের এই দিনের কথা বলব। আমি গর্বিত, আমার পরিবারও গর্বিত।'