বাসস
  ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৩

খরা-কবলিত চিলিতে আশার আলো দেখাচ্ছে  স্বল্প-পায়ী 'জাস্পে' ধান

ঢাকা, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : লম্বা সময় ধরে খরা-কবলিত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে নতুন একটি স্বল্প জল-পিয়াসী ও খরা-সহিষ্ণু ধান উদ্ভাবনের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে সেচ ও পানি স্বল্পতায় এবং খরা বা অনাবৃষ্টির মতো বিরূপ আবহাওয়ায় ধান উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন দেশটির গবেষকেরা।

চিলির নিকুয়েন থেকে এএফপি জানায়, চিলির কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএনআইএ)-এর ধান প্রজনন কর্মসূচির গবেষক কৃষিবিজ্ঞানী কার্লা কোর্দেরো ‘জাস্পে’ নামে এ নতুন ধান জাতটি উদ্ভাবন করেছেন, এটি কম-পিয়াসী বা স্বল্প-পায়ী, অর্থাৎ, এটি সাধারণ ধানের তুলনায় অনেক কম পানি ব্যবহার করে চাষ করা যায়।

কৃষিবিজ্ঞানী কার্লা কোর্দেরো বলেন, জাস্পে ধানগাছগুলো ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি কিংবা তাপপ্রবাহও সহ্য করতে পারে। ফলে নিয়মিত পানি সেচ ছাড়াও ধান চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। চিলি ও রাশিয়ার দুটি ধানের জাত সংকর করে খরা-পীড়িত ঠান্ডা ও শুষ্ক অঞ্চলের উপযোগী করে এটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

জাস্পে’ শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘জ্যাসপার'—এটি এক ধরনের রঙিন, মূল্যবান পাথর বা রত্ন। এটি সাধারণত লাল, হলুদ, বাদামি বা সবুজ রঙের হয়ে থাকে এবং এটি শক্ত-পাথুরে গঠনবিশিষ্ট।

এই নামটি নতুন ধান জাতের দৃঢ়তা, স্থায়িত্ব এবং শুষ্ক পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে—জ্যাসপার পাথর  যেমন কঠিন ও টেকসই।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিশ্বজুড়েই কৃষি খাত চরম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে খাদ্য উৎপাদনের প্রচলিত পদ্ধতি অনেকাংশেই অকার্যকর হয়ে পড়ছে।

বিশেষ করে ধানচাষের মতো পানিনির্ভর শস্যের ক্ষেত্রে এই সংকট আরও প্রকট। এ অবস্থায় টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে ঝুঁকছে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা।

চিলির মতো শুষ্ক ও শীতল অঞ্চলে ধানচাষ সম্ভব করে তোলার লক্ষ্যে এই পরীক্ষামূলক সাফল্য শুধু দক্ষিণ আমেরিকাই নয়, বরং বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

চিলির নিকুয়েন অঞ্চলের শুষ্ক ও শীতল জলবায়ু ধান চাষের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয় বলেই দীর্ঘদিন ধরে ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরার মধ্যেও সেখানে ধানের এই নতুন জাত চাষ করে আশার আলো দেখাচ্ছেন স্থানীয় কৃষক হাভিয়ের মুনিয়োস।

নিকুয়েন এলাকার কৃষক হাভিয়ের মুনিয়োস এই নতুন জাতটি পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করছেন। তিনি জানান, নতুন ধানচাষ পদ্ধতি ও ‘জাস্পে’ জাতের ধান ব্যবহার করে তিনি আগের তুলনায় অর্ধেক পানি খরচ করেও দশগুণ ফলন পেয়েছেন।

এই পরীক্ষামূলক তার এ প্রয়াসের তাকে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী করে তুলেছে।

স্বল্প সেচনির্ভর ‘সিস্টেম অব রাইস ইন্টেনসিফিকেশন (এসআরআই)’ বা নিবিড় ধানচাষ নামের নতুন পদ্ধতিতে জাস্পে ধানচাষে শুধু পানি ও বীজ কম লাগছে তা না, বরং পরিবেশবান্ধব দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্লাবিত ধানক্ষেতে নানা প্রাকৃতিক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গত হয়, যা গরুর পরে অন্যতম বড় গ্রিনহাউজ গ্যাসের উৎস।

চিলির নাগরিকরা বছরে গড়ে ১০ কেজির মতো চাল খান। এর অর্ধেকই দেশেই উৎপাদিত হয়, যার ৮০ শতাংশই ঐতিহ্যগত প্লাবিত পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে এক কেজি চাল উৎপাদনে প্রায় ২,৫০০ লিটার পানি লাগে। যদিও এতে আগাছা দমন ও চারার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়, তবে একই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হয়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে মানবসৃষ্ট মিথেন নির্গমনের প্রায় ১০ শতাংশই আসে ধানক্ষেত থেকে। কিন্তু জাস্পে জাত ও তার সঙ্গে ব্যবহৃত এসআরআই  (সিস্টেম অব রাইস ইন্টেনসিফিকেশন) চাষপদ্ধতিতে মিথেনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।

চিলিতে বর্তমানে ৮০ শতাংশ ধানই চাষ হয় প্লাবিত পদ্ধতিতে, যাতে প্রতি কেজি ধানের জন্য প্রায় ২,৫০০ লিটার পানি প্রয়োজন হয়। অথচ দেশটির অধিকাংশ ধান উৎপাদিত হয় নুবলে ও মউলে অঞ্চলে, বর্তমানে দীর্ঘ ১৫ বছরের প্রকট খরার প্রভাবে সেখানে ধানচাষ হুমকির মুখে পড়েছে।

রাশিয়ার একটি শীত-সহিষ্ণু জাতের সঙ্গে চিলির স্থানীয় জাতের সংমিশ্রণে এই ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন আইএনআইএ-র কৃষি প্রকৌশলী কার্লা কর্দেরো। প্রায় ২০ বছর গবেষণার পর তিনি ২০২৩ সালে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সম্মেলনে এর ফলাফল উপস্থাপন করেন।

কোর্দেরো জানান, এই ধান শুধু কম পানি ও বীজেই উৎপাদন সম্ভব নয়, বরং ঝড়, বন্যা ও তাপপ্রবাহের প্রতিও এটি অনেক বেশি সহিষ্ণু। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় এরকম সহনশীল জাত উদ্ভাবনই যে ভবিষ্যতের পথ, সে কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।

২০২৩ সালে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সম্মেলনে কোর্দেরো প্রায় ২০ বছরের গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেন। যদিও গবেষণাটি এখনও কোনো স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়নি, তবে চিলির কৃষি ও প্রাণিসম্পদ দপ্তর ইতোমধ্যে এই জাতটির বাণিজ্যিক চাষের অনুমতি দিয়েছে।

এফএও--এর ধান গবেষক মাকিকো তাগুচি বলেন, 'চিলির এই উদ্যোগ ধান উৎপাদন পদ্ধতি উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাব কমানোর ক্ষেত্রে একটি আশাব্যঞ্জক পথ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সহনশীল জাত উদ্ভাবনই হচ্ছে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।'

চিলির পর এবার ব্রাজিলসহ অন্যান্য দক্ষিণ আমেরিকান দেশেও এই জাতের ধান পরীক্ষা করার পরিকল্পনা রয়েছে গবেষকদের। কোর্দেরো আশা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে আক্রান্ত আরও অনেক দেশেই এই পদ্ধতিটি কাজে লাগবে।

১৯৮০-এর দশকে মাদাগাসকারে উদ্ভাবিত স্বল্প সেচনির্ভর ‘সিস্টেম অব রাইস ইন্টেনসিফিকেশন (এসআরআই)’ বা নিবিড় ধানচাষ পদ্ধতিতে দুটি চারার মাঝে বেশি ফাঁক রাখা হয়, মাটি পুষ্টিতে সমৃদ্ধ হয় এবং পানি দেওয়া হয় নির্দিষ্ট বিরতিতে। এতে গাছের শিকড় আরও বলিষ্ঠ হয় এবং জলবায়ুর প্রতিকূলতা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ে।

২৫ বছর বয়সী মুনিয়োস বলেন, 'চিরাচরিত প্লাবিত ধানক্ষেত বাদ দিয়ে সেচনির্ভর চাষে যাওয়া এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। আমরা খাদ্য নিরাপত্তা চাই, আবার পরিবেশও বাঁচাতে চাই—তাহলে এই পথই ভবিষ্যৎ।'

মুনিয়োস বলেন, 'এই পদ্ধতিই ভবিষ্যৎ। আমরা যদি খাদ্য নিরাপত্তা চাই, পরিবেশ রক্ষা করতে চাই—তাহলে এ পথেই এগোতে হবে।'