শিরোনাম
\\ রুমানা জামান \\
ঢাকা, ২৫ মার্চ, ২০২৫ (বাসস): বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘রক্তঝরা সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘একটি দেশের জনগণের স্বাধিকারের লড়াই-সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না। আমাদেরও মনে হয়েছে, জনযুদ্ধ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ কখনো ব্যর্থ হবে না। এ যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে আমার পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন আমি হয়ত বেঁচে ফিরব না। কিন্তু আমার কখনো এ রকম মনে হয়নি। আমরা সবসময় অত্যন্ত আশাবাদী ছিলাম, হয়তো লম্বা সময় লাগতে পারে তবে বাংলাদেশ অবশ্যই স্বাধীন হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কখনো কী মনে হয়েছে আপনি বেঁচে ফিরবেন না, এই প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন।
যুদ্ধকালে আপনার কাছে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তখন হয়েছি, যখন আমরা যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আমাদের শত্রু মনে করতে শুরু করল। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হতে না পারি সে জন্য সব চেষ্টা তারা করেছে। যে কোনো ভাবে আমাদের বিপদে ফেলার জন্য তারা ওত পেতে থাকত। এ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে কাজ করাটা ভীষণ চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো সময়টাতে আওয়ামী লীগ কখনোই আমাদের মেনে নিতে পারেনি।’
যেমন বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, আজকের এই জায়গায় এসে আপনার কি মনে হয় সেই বাংলাদেশ পেয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কিছুটা মলিন মুখে বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা ফখরুল বলেন- ‘না পাইনি। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম সেই বাংলাদেশ আমরা পাইনি। আমরা যে দেশের জন্য শুধু ২৬ মার্চে নয় তার আগে থেকেই লড়াই করে আসছিলাম। তখন থেকেই আমরা যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম, একটা বৈষম্যহীন, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। অথচ আজকে আমরা সেই জায়গায় নেই।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমি সবে মাস্টার্স পাস করেছি। বয়স ২৫ বা ২৬ হতে পারে। আমি তখন ঠাকুরগাঁয়ে ছিলাম। ক্র্যাকডাউনের পরে ঠাকুরগাঁয়ে তখন বিডিআর কমান্ডার অফিসার ছিলেন যিনি পশ্চিম পাকিস্তানি। বাকিরা বেশিরভাগ ছিল বাঙালি। ২৫ তারিখ রাত্রের পরেই ওখানে বিডিআর কারফিউ দেয়। ওই সময় লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ২৫ তারিখ সকালবেলা থেকেই গোলাগুলি শুরু হয়। গুলিতে তিন-চারজন শহীদ হয়। তারপর সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। আমরা তখন তৎকালীন ঠাকারগাঁও মহাকুমায় মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমরাও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই এবং একটা বাসায় আশ্রয় নেই। তখনই জানতে পারি দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধ শুরু হয়েছে।’
তিনি বলেন, ২৬ তারিখে রাত্রিবেলা আমরা প্রথম জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনতে পাই। ২৭ তারিখে পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা শুনতে পাই। এটা শুনেই আমরা সবাই রাস্তায় বেরিয়ে আসি। মানুষকেও বের হওয়ার জন্য ডাকতে থাকি। তখন ওখানকার এসডিপিওকে গিয়ে বলি তোমার আর্মসের আলমারিটা খুলে দাও। খুলে দেয়ার পরে সেখান থেকে কিছু আর্মস নিই। পরে বিডিআরের কিছু অংশ বিদ্রোহ করে। তারাও আমাদের সঙ্গে একই জায়গায় শেল্টার নেয়। তাদের সহযোগীতায় আমরা সৈয়দপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে যে হাইওয়ে রাস্তাটা আসছে, এই রাস্তাটা ধরে যে ব্রিজ এসেছে সেটা কেটে দিই। যাতে সৈয়দপুর থেকে পাকবাহিনী আসতে না পারে। ভোরের দিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা অংশ আসে। তখনকার বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারের নাম ছিল ক্যাপ্টেন নাসের। পরে সে মেজর জিয়াউর রহামনের আমলে এনএসআই চিফও হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিডিআরের দিনাজপুরের তৎকালীন কমান্ডার মেজর নজরুলের নেতৃত্বে একটি কমান্ডো তৈরি করা হয়। তারা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিছুটা ডিফেন্সিভ ব্যবস্থাও নেয়। এ সময় ঠাকুরগাঁও শহরে আমরা একটি ‘কন্ট্রোল রুম’ এস্টাবলিশ করি। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের আর্মস ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ১৪ এপ্রিল সৈয়দপুর থেকে পাক আর্মি অর্গানাইজড হয়ে কাউন্টার শেলিং শুরু করে। মর্টারশেল দিয়ে তারা পুরো দিনাজপুরে আক্রমণ করে। যখন খুব বেশি শেল পড়তে থাকে, তখন আমাদের যে হেডকোয়ার্টার তা ধ্বংস হয়ে যায়। বিডিআরের বেঙ্গল রেজিমেন্টের অংশ তখন ঠাকুরগাঁও ছেড়ে পঞ্চগড়ের বর্ডারে চলে যায়। জায়গায়টা একদম ভারত সীমান্তের কাছাকাছি। ওইখানে সবাই গিয়ে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। কিন্তু আমরা সেখানে আশ্রয় নিইনি। আমরা আমাদের পাশে থুকরাবাড়ি বর্ডার দিয়ে নাগর নদী পার হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাই। আমার পুরো ফ্যামিলিও ইন্ডিয়ায় চলে যায়। অর্থাৎ আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, আমরা সবাই ওই পারে চলে যাই।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ওখানে গিয়ে আমরা পরিচিতদের কাছে আশ্রয় নিই। পশ্চিম দিনাজপুরে ইসলামপুর শহর নামে একটি সাবডিভিশন শহরে আশ্রয় নিই। সেখানে দিলীপের সাইকেল স্টোর নামে একটি সাইকেল স্টোরে থাকি। এই দিলিপের সঙ্গে যুদ্ধের সময় আমাদের পরিচয় হয়। সে আমাদের থাকার জায়গা দেয়। তার সাইকেল স্টোর আলমিরার পেছন দিকে একটু ছোট জায়গায় রাতে খুব কষ্ট করে থাকতাম। জায়গাটা এতো ছোট জায়গা যে কোনো রকমে মাথাটা রাখা যেত। আমার চাচা বাবলু মির্জাসহ সাতজন সেখানে থাকতাম।
তিনি বলেন, আমরা তখন চেষ্টা করেছি ভারতের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের জন্য একটা ইউথ ক্যাম্প করতে পারি কি না। পরে পশ্চিম বাংলা সরকার আমাদের ইসলামপুর হাই স্কুলে শিফট করে দেয়। পরবর্তীতে আমরা সেখানেই থাকতাম। আমরা বর্ডারে অর্গানাইজিং ইউথ ক্যাম্প তৈরি করি। এক সময় বিহারের চিফ মিনিস্টার ফুরপুরি ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের আরও কিছু ইউথ ট্রেনিংয়ের জন্য ব্যবস্থা করে দেন। আমাদের পরিধানের জন্য প্রয়োজন মতো পোশাকও দেন।
এরপরে কয়েকটা ইউথ ক্যাম্প তৈরি হয়। বর্ডার এলাকায় একটা ক্যাম্পের নাম ছিল থুকরাবাড়ি ইউথ ক্যাম্প। থুকরাবাড়ি ইউথ ক্যাম্পে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অব ইন্ডিয়া বিএসএফ-এর ক্যাম্প কমান্ডার সুভাসের নেতৃত্বে ট্রেনিং শুরু হয়। এরপরে আস্তে আস্তে যখন আরো অর্গানাইজড হয়, তখন ইন্ডিয়ার সেন্ট্রাল গর্ভমেন্ট যুক্ত হয়। তারা বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। বিশেষ করে পরবর্তীকালে দেরাদুন এলাকায় ওরা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। আমরা আমাদের ছেলেদের সেখানে রিক্রুট করি। আমরা নিজেরা কো-অর্ডিনেট করতে থাকি, আমরা মূলত সংগঠকের ভূমিকাটা পালন করি। এরপরে তো বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স তৈরি হয়। তারা রিক্রুটমেন্ট শুরু করে। এভাবেই আমরা কাজ করেছি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘২৬ মার্চটা ছিল মূলত বিগিনিং এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের যে স্বাধীনতার ঘোষণা, সেই ঘোষণার মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। শুধু আমরা নই, দেশের সব মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ গত ১৫ বছর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে অস্বীকার করা হয়েছে। ‘বাট দ্যাট ইজ দা রিয়েলিটি’। শুধু আমার কথা নয়। ওই সময় যারাই ছিলেন তারা সবাই এটা জানেন। সত্যিকারের ইতিহাস কখনোই মুছে ফেলা যায় না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, শেখ মুজিব ধরা পড়ে পাকিস্তানিদের হাতে চলে যান ‘সেন্স অব ডিরেকশনে’ (একক সিদ্ধান্তে)। আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথমেই ইন্ডিয়াতে চলে যায়। তারা প্রথম দিকে কোনো নেতৃত্ব দিতে পারেনি। ইন্ডিয়ায় গিয়েও তারা অনেক পরে নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজ শুরু করে। তখন আমরা যারা বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম, তারা আরেকটা বড় বিপদে পড়ি। আওয়ামী লীগ আমাদের ‘ওউন’ করতে চায় না। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে আমাদের বহু লোককে গ্রেফতার করায়। এমনকি আমাকেও বহুবার থানায় হাজিরা দিতে হয়েছে। যে কারণে আমরা বাম সংগঠনগুলো মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে একটা ফ্রন্ট তৈরি করি। সেখানে আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর আহমেদ সবাই ওই ফ্রন্টের ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধের কাজ শুরু করি।
গত ১৫ বছর ধরে যারা ক্ষমতায় ছিল, সেই আওয়ামী লীগ ধারাবাহিক ভাবে বলে আসছিল আপনার বাবা একজন রাজাকার ছিলেন। একজন মুক্তযোদ্ধা হিসেবে বিষয়টি আপনার জন্য কতোটা কষ্টের ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আমার বাবা ১৯৪৭ এর আগে মুসলিম লীগ করতেন। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। আমার বাবা একজন অত্যন্ত প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি কখনোই প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ ছিলেন না। তার হাত দিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে মেয়েদের স্কুল ও কলেজ তৈরি হয়েছে। তিনি খুব জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। প্রায় ২৫ বছর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলেন।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর বাবা ভারতের ইসলামপুরে ছিলেন। আমরাই তাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। সুতরাং তার রাজাকার হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কোন সুযোগই নেই। এর কোন প্রমাণও নেই।