শিরোনাম
ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫(বাসস) : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেছেন, দেশের নারীরা অচলায়তন অতিক্রম করে স্বত:স্ফূর্তভাবে আইন পেশার সাথে সংযুক্ত হচ্ছেন।
আপিল বিভাগের নতুন দুই বিচারপতিকে দেয়া সংবর্ধনায় তিনি আজ একথা বলেন।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব তার বক্তৃতায় বলেন, ‘গণতন্ত্রের বহুবিধ উৎকর্ষের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল, জনগণের অভিপ্রায়, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিগত অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা।’
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘আইনাঙ্গনে আমার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৬ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়নের মাধ্যমে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আইন-আদালতের সাথে আমার পরিচয় হয় ছোটবেলা থেকেই। আমার পিতা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান সুপ্রিম কোর্টের একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন। আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর বলিষ্ঠ পদচারণা সেই বাল্যকাল থেকেই আইনের সঙ্গে আমার সখ্যতার সেতুবন্ধন তৈরি করে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশের পর আইনের সাথে সেই সখ্য, ভালোবাসায় পরিণত হয় যার উৎসাহে, সেই মানুষটি ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড: মফিজুল ইসলাম পাটোয়ারী। স্যারের হাত ধরেই আইনের সুবিশাল জগতে প্রবেশ করতে শিখেছি। আমি বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছি আমার সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে, যাঁদের অসামান্য জ্ঞানের আলো আইনের জগতে আমাকে পথ প্রদর্শন করেছে।’
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব জানান, আইন পেশায় তার প্রথম হাতেখড়ি হয় তার পিতার নিকট। তিনি ছিলেন আইন জগতের দূর্গমপথ পাড়ি দেওয়ার আলোকবর্তিকা।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘বিচারক হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু হয় ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হবার মাধ্যমে। সে সময় বিচারপতি আনোয়ারুল হক স্যারের জুনিয়র জাজ হিসেবে তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকে আদালত পরিচালনা, আইনের ব্যাখ্যা ও রায় লেখার কৌশল শেখার সুযোগ পাই। তার কাছ থেকেই শিখেছি কিভাবে বিচারপ্রার্থী জনগণের বিচারিক সেবা প্রাপ্তির অধিকার সর্বোত্তম উপায়ে সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়।’
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘আমাদের দেশে এক সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণা ছিল, আইনপেশা নারীদের জন্য উপযুক্ত নয়। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এই যে বর্তমান সময়ে, আমাদের দেশের নারীরা সেই অচলায়তনকে অতিক্রম করে স্বত:স্ফূর্তভাবে আইনপেশার সাথে সংযুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে মোট আইনজীবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী আইনজীবী রয়েছেন, যারা আদালতে মামলা পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে নারী বিচারক মোট বিচারক সংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ, যারা দক্ষতার সাথে বিচারকার্য পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে নারী বিচারকের সংখ্যা বর্তমানে ১০ জন। এই সংখ্যা অদূর ভবিষ্যতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘এই সংখ্যা বৃদ্ধি শুধু নারীর ক্ষমতায়নের জন্যই নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা (access to justice) নিশ্চিতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন অনেক মামলার বিষয়বস্তু রয়েছে, যেখানে বিশেষভাবে নারীরাই ভিকটিম অথবা বিচারপ্রার্থী হন। এসব ক্ষেত্রে নারী আইনজীবী বা নারী বিচারক বিচারকার্যের সাথে জড়িত থাকলে বিচারপ্রার্থীর জন্য তা স্বস্তিদায়ক হয় এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে আরও জনমুখী ও লিঙ্গ বান্ধব করে তোলে।’
সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য শুধু বিচারকগণই নয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে আইনজীবীগণও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন উল্লেখ করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, আদালতের অফিস সহায়ক থেকে শুরু করে সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও এই মহাযজ্ঞের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে প্রতিটি মানুষের আইনের আশ্রয় লাভ ও বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৭২ সালে ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সৃষ্টির উষালগ্ন হতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড: সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগকে একটি আধুনিক, সময়োপযোগী ও গতিশীল বিভাগ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন এবং এর বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি প্রধান বিচারপতি’র বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিচার প্রার্থী জনগণ অচিরেই এর সুফল ভোগ করতে পারবেন। আমাদের বিচার বিভাগ দেশ ও জনগণের আইনি ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে যাবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আপিল বিভাগের নতুন দুই বিচারপতিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। যে দুই বিচারপতিকে আজ সংবর্ধনা দেয়া হয় তারা হলেন- বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। রীতি অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন দুই বিচারপতির জীবনী তুলে ধরে অভিনন্দন বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এরপর আপিল বিভাগের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বক্তব্য রাখেন। এসময় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। পরিশেষে প্রধান বিচারপতি এই সংবর্ধনায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
গত ২৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এই দুই বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। পরদিন সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে দুই বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাসের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।