শিরোনাম
॥ কামাল আতাতুর্ক মিসেল ॥
কুমিল্লা (দক্ষিণ), ২৪ আগস্ট, ২০২৩ (বাসস) :জেলার কোটবাড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) ১৯৫৯ সালের ২৭ মে পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সূচনালগ্নেই একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে নিবেদিত প্রাণ কিছু গবেষক গ্রামীণ জনগণকে সাথে নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে এ দেশে পল্লী উন্নয়নের উপযোগী কিছু মডেল কর্মসূচি উদ্ভাবন করেন এবং সমাধানের পথ দেখান।
সেই ১৯৫৯ সালের কথা। আজ থেকে ৬৪ বছর আগে। আখতার হামিদ খান নামের এক সমাজবিজ্ঞানী শিক্ষক গতানুগতিক কাজের বাইরে অন্য রকম স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল গ্রামকে ঘিরে। গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমেই তিনি মানুষ ও সমাজের আর্থসামাজিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেসব স্বপ্ন ডানা মেলেছে কুমিল্লায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মাধ্যমে।
কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড় ও টিলাঘেরা কোটবাড়ী এলাকার ১৫৬ একর জমির ওপর বার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ময়নামতি পাহাড়ের অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে অটুট রেখে গ্রিক স্থাপত্যের আদলে ডাক্স এডিস ফার্মের নকশায় তৈরি হয় এখানকার ভবনগুলো। এখানকার এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যেতে কোনো রোদ লাগে না। বৃষ্টিতেও ভিজতে হয় না। আর ভবনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে নানা দুর্লভ প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ।
বার্ড স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পল্লী উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বার্ডের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ আছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি। আর বার্ডের মহাপরিচালক হলেন এর প্রধান নির্বাহী। বর্তমানে বার্ডে একজন মহাপরিচালক, একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক, নয়জন পরিচালক ও পঞ্চাশজন অনুষদ সদস্য আছেন।
বার্ড সূত্র জানায়, বার্ড উদ্ভাবিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন করছে। এখন এখানে কাজ করেন ৪০০ জন। এখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৮৫০টি গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত পল্লী উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়ে চার লাখের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বার্ডে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। বার্ডের প্রতিষ্ঠাতার নামেই নামকরণ করা হয়েছে এ গ্রন্থাগারের। সেখানে আছে দেশ-বিদেশের প্রায় ৭০ হাজার বই।
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের বিশিষ্ট সমবায়ী ও আখতার হামিদ খানের সহচর মো. সিরাজুল হক (৭১) বার্ডের শুরু দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বাসসকে বলেন, পঞ্চাশের দশকে আখতার হামিদ খান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থী ক্লাসে আসত না, বিষয়টি তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সাইকেল চালিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি যেতেন। সেই বাড়ি বাড়ি যাওয়া তাঁর জীবনকে বদলে দেয়। কতটা দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, তা দেখে তিনি গ্রামের মানুষের উন্নয়নে একটা কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন।
সিরাজুল হক বলছিলেন, ১৯৫৯ সালের ২৭ মে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে পল্লী উন্নয়নের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বার্ড যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে কয়েকজন গবেষক গ্রামের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে কিছু মডেল কর্মসূচি উদ্ভাবন করেন। তাঁরা প্রথমে গ্রামাঞ্চলের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন। এরপর কী উপায়ে সেসব সমস্যার সমাধান করা যায়, এর পথ খোঁজেন। গ্রামে টেকসই সংগঠন সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পুঁজি সৃষ্টি, স্বাস্থ্য-শিক্ষার প্রসার, কৃষি খাতের মাধ্যমে কর্মসংস্থানসহ নয়টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বার্ড কাজ শুরু করে। আখতার হামিদ খান প্রথমে কৃষক, রিকশাচালক ও মৃৎশিল্পীদের নিয়ে সমবায় সমিতি চালু করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগ তো এখন খুবই পরিচিত।
বার্ডের নানা কর্মকান্ড প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ মীর কাসেম বাসসকে বলেন, ষাটের দশকে আখতার হামিদ কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার দক্ষিণ রামপুর এলাকায় যান। দেখতে পান ওই এলাকা নিচু। বছরে এক ঋতুতে ধান হয়। খরা ও শীত মৌসুমে মাঠে কোনো ফসল নেই। তখন তিনি কৃষকদের নিয়ে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের কৃষকেরা চাঁদা দিয়ে সদস্য হন। পরে কৃষকদের জন্য তিনি গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচকাজ শুরু করেন। ফিলিপাইনের ম্যানিলা থেকে ইরি ধানের জাত আনেন। তখন ওই এলাকায় বছরে তিন ঋতুতে ধান উৎপাদন শুরু হয়।
মোহাম্মদ মীর কাসেম আরও বলেন, কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বলরামপুর গ্রামে রিকশাচালকদের দিয়ে সমিতি করেন আখতার হামিদ খান। সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরে তিনি মৃৎশিল্পীদের জন্য সমবায় সমিতি করেন। সমিতির শুরুর সদস্য ছিল ১৫ জন। সমিতির নাম দেওয়া হয় বিজয়পুর রুদ্র পাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। শুরুতে সমিতির সদস্যরা ৫০ পয়সা চাঁদা দিয়ে সদস্য হন। আর ১০ টাকা করে শেয়ার কিনে মোট ১৫৭ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে সমিতির যাত্রা শুরু করেন। এখানকার মৃৎশিল্পীরা সারা বছর আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেন। এমন শত শত প্রশিক্ষিত কর্মী দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে মাটির কাজ করে যাচ্ছেন। বিজয়পুরের মাটির জিনিস এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বিক্রি হয়।
পল্লী উন্নয়ন, সমবায় আন্দোলন, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্রে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে বার্ড। বাংলাদেশ সরকার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বার্ডকে ১৯৮৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে। বার্ডের ঝুলিতে ২০২১ সালে জমা হয়েছে জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদকও। বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান ১৯৬৩ সালে, নারী কর্মসূচির কর্মী তাহেরা আবদুল্লাহ ১৯৭৮ সালে ও সমবায় প্রতিষ্ঠান দিদার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মো. ইয়াছিন ১৯৮৮ সালে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন। বার্ডের মহাপরিচালক মো. শাহজাহান জানান, বার্ড বর্তমানে ১৪ টি প্রায়োগিক বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। ৬৪ বছরে বার্ড এগিয়েছে অনেক দূর। তবে পাড়ি দিতে হবে আরও বহু পথ। বার্ডে বঙ্গবন্ধু স্কুল অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট হচ্ছে। এখান থেকে গ্রামীণ গবেষণার বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হবে।
৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা পল্লীর দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে যাচ্ছে। পাশপাশি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের জন্যও প্রসিদ্ধ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসেন। বার্ডের ভেতরে গেলেই দেখা মিলবে সবুজের সমারোহ ও পিনপতন নীরবতার যুগপৎ সমন্বয়। এখানের অতিথিদের থাকার জন্য রয়েছে ‘বন কুঠির, রানী কুঠির’ নামে বেশ কয়েকটি অতিথিশালা। নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে ভাড়া নিয়ে যে কেউই থাকতে পারবে এ চমৎকার কুটিরগুলোতে। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং বনভোজনের জন্য রয়েছে হলরুমসহ অন্যান্য আয়োজন। বিভিন্ন সময়ে এখানে নাটক এবং সিনেমার শ্যুটিংও হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে কার্যক্রমের জন্য তো বটেই, সৌন্দর্যের জন্যেও বার্ড অনন্য।