শিরোনাম
চট্টগ্রাম, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ (বাসস) : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ আগামী ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করা হবে।
উদ্বোধনের পরদিন (২৯ অক্টোবর) টানেলের ভেতরে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আমাদের দেশের সম্পদ। দেড় মাস পর এর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসন আয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিমূলক সভা শেষে সেতু সচিব মো. মনজুর হোসেন ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
সেতু সচিব বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল শুধু চট্টগ্রামের জন্য নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্য একটা গর্বের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় টানেল প্রস্তুত হয়েছে বলতে পারি আমরা। আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী এটা উদ্বোধনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এখানে এসে এই টানেল উদ্বোধন করবেন।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর প্রিকমিশনিং, কমিশনিং থেকে শুরু করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা গুলো দেখা হয়েছে। আশা করছি আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর থেকে আপনাদের কাঙ্খিত টানেল দিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলার গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেওয়ার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সচিব বলেন, টানেলের ধারণা আমাদের জন্য নতুন। এটি সাধারণ সেতু এবং সড়ক থেকে আলাদা। এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এখানে ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলবে। এ কারণে মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলার গাড়ি না চললে টানেল এবং টানেল ব্যবহারকারীরা নিরাপদ থাকবে।
টানেল নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ওয়ান সিটি টু টাউন নিয়ে তিনি বলেন, যদিও এটা সরকারের অন্য একটি প্রকল্প, সেতু বিভাগের যে বিষয়টি ছিল, টানেলটি তৈরি করা। প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন ওয়ান সিটি টু টাউন। নিশ্চিতভাবে দেখতে পাচ্ছেন যে গত কয়েক বছরের মধ্যে পতেঙ্গা প্রান্তে ডেভেলপমেন্ট আগেই ছিল, সেটা নতুন করে হচ্ছে। আনোয়ারা প্রান্তে গত পৌনে দুই বছর যাবৎ আমি দেখছি চোখের সামনে পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যায়।
টানেলের কাজের অগ্রগতি বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ বলেন, টানেলের দুই সড়কপথের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। টোল প্লাজা ও অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। পুরো প্রকল্পের ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। অক্টোবরে উদ্বোধনের পর যানচলাচল শুরু হয়ে যাবে এবং এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কাজও চলতে থাকবে।
সভায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি নুরে আলম মিনা, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হারুনুর রশীদ চৌধুরীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা টোল অনুযায়ী, টানেলে প্রাইভেটকার ও জিপকে দিতে হবে ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসকে ২৫০ টাকা, পিকআপকে ২০০ টাকা, ৩১ বা তার চেয়ে কম সিটের বাসকে ৩০০ টাকা এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসকে দিতে হবে ৪০০ টাকা। আবার ৫ টন ধারণক্ষমতার ট্রাক থেকে টানেলে টোল নেওয়া হবে ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকে ৫০০ টাকা এবং ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। এছাড়া ৩ এক্সেল পর্যন্ত ট্রাক চলাচলে টানেলে টোল দিতে হবে ৮০০ টাকা এবং ৪ এক্সেল পর্যন্ত ট্রেইলারকে ১ হাজার টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি হলে প্রতি এক্সেলের জন্য দিতে হবে ২০০ টাকা।
জানা গেছে, নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী- টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসেবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। টানেল চালু হলে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে ওঠবে নতুন শিল্পকারখানা।
টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। সবশেষ গত বছরের ২৬ নভেম্বর টানেলের প্রথম টিউবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।