শিরোনাম
হবিগঞ্জ, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ (বাসস): তিল থেকে তাল প্রবাদ বাক্যের সাথে অনেকেই পরিচিত। প্রবাদ বাক্য হলেও এ প্রবাদের বাস্তব উপস্থিতি আছে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে। গল্প,সিনেমা আর নাটকও হয়েছে অনেক। কিন্তু ‘তাল থেকে বিল্ডিং’। এ শব্দটি শুনেনি কেউ। বাস্তবে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জের পল্লী গ্রাম সুলতানশী গ্রামে। ওই গ্রামের সজিব মিয়া নামে এক কৃষক ৩০ বছর যাবৎ তাল উৎপাদন ও তাল নিয়ে ব্যবসা করে করেছেন নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন। বাড়ীতে করেছেন বিল্ডিং। হয়েছেন বাজারের দোকান ভিটের মালিক।
ভাদ্র মাসের গরমে, তাল পাকে চরমে। আর এ গরমে এক মাসে সজিব মিয়ার হাতে আসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন তালমন, মালপোয়া, পাঠিসাপটাসহ তালের পিটার জন্য তালের অনেক কদর। আর এ তালের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশি^ত করেন সজিব মিয়া। শুধু হবিগঞ্জ জেলা শহরই নয়। জেলার বিভিন্ন উপজেলা, এমনকি জেলার বাহিরের পাইকাররা আসে তার কাছে তাল ক্রয়ের জন্য।
সজিব মিয়া জানান, তার দাদা বাড়ীতে ৬টি তাল গাছ লাগান। ৩০ বছর আগে তিনি যখন বিয়ে করেন তখন এ গাছগুলোতে ফল আসতে থাকে। গাছে উঠে তার পেড়ে সেগুলো নিয়ে বাজারে বিক্রি করে ভ ালো টাকা পাওয়া যায়। তখন থেকেই মাথায় চিন্তা আসে তালের ব্যবসা করার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন জেলার পাহাড়ী এলাকা চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর,আমরোডসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক তাল গাছ আছে। তিনি ভাদ্র মাস আসার আগেই ওই সকল এলাকা থেকে চুক্তিতে গাছ ক্রয় করেন। পরে তাল পেড়ে বাজারে বাজারে বিক্রি করেন। পাইকাররা তার বাড়ীতে এসে তাল নিয়ে যায়। আবার পাইকারী বাজারে প্রতিদিন বিক্রি করেন পাকা তাল।
সজিব মিয়া জানান, প্রতি বছর ১ থেকে ২শ তালগাছের ফল ক্রয় করেন। ফলন অনুযায়ী ২ থেকে ৩হাজার টাকায় ক্রয় করেন একেকটি গাছের ফল। পরে ৫/৬ হাজার টাকার তার বিক্রি হয় একেকটি গাছ থেকে। কোন গাছে দুই থেকে তিনশ তাল পাওয়া যায়। তালের সাইজ অনুযায়ী ২০ থেকে ৯০টাকা পিস বিক্রি হয়। আবার পাইকাররা ৩০ থেকে ১২০টাকা পিস বিক্রি করেন এ তাল। হবিগঞ্জ শহরের চাষী বাজারে ভাদ্র মাস শুরুর আগে থেকেই ১দিন পর পর তিনি দুই থেকে ৩শ তাল নিয়ে আসেন বিক্রি করার জন্য। পাইকাররা এখান থেকে তাল কিনে নিয়ে যান। শহরের অন্যান্য বাজারেও তিনি তাল বিক্রি করেন। জেলার বানিয়াচং,আজমিরীগঞ্জ,লাখাই,নবীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা তার বাড়ী থেকে এসেও তাল কিনে নিয়ে যান। ৪০ দিনের মাঝেই শেষ হয় তালের ব্যবসা। এ সময়ে মুনাফা আসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। কোন বছরই লোকসান হয় না। তবে মাঝে মাঝে কিছু তাল পচে যায়। সেই পচে যাওয়া তালের বীজ বিক্রি করেও পাওয়া যায় অনেক টাকা। পচা তাল ও বিক্রিত তালের বীজ তিনি সরকারী বিভিন্ন অফিস ও সংস্থায় বিক্রি করেন ১০টাকা পিস হিসেবে। প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ হাজার বীজ বিক্রি করে আরও ৪০/৫০ হাজার টাকা আয় হয়।
সজিব মিয়া জানান, এখন তার বয়স ৫৩ বছর। ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে বড় হয়েছে। তারা সকলেই লেখাপড়া করেছে। এক ছেলে আশাতে চাকুরী করে। আরেক ছেলে পড়া লেখা করছে। একজন কৃষি কাজে জড়িত। তার তিন ছেলেই ভালো ফুটবলার। শুরুতে তিনি নিজেই গাছে উঠলেও এখন শ্রমিক দিয়ে তাল পাড়ান।তাল পাড়তে একজন শ্রমিককে গাছ প্রতি ২শ টাকা দিতে হয়। এ মজুরী এবং গাড়ীর ভাড়া ছাড়া আর তেমন কোন খরচ নেই। তাল দিয়ে ব্যবসা শুরু হলেও এখন তিনি তেতুল, বেল, আম, কাঠাল, জাম্বুরা, টক বড়ইও বিক্রি করেন। তালের মত করেই কিনে নেন এসকল ফলের গাছ। পরে পাইকারী বাজারে বিক্রি করেন। সবাই তাকে এক নামে চিনে। মোবাইলে যোগাযোগ করেনই সবাই ফল কিনে তার কাছ থেকে। দেশী ফল বিক্রি করে তিনি লাভবান। পরিবারের সদস্যরাও ফরমালিনমুক্ত টাটকা ফল খেতে পারায় সবাই সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। নিজের বাড়ীর ৬টি তাল গাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং ২টি জাম্বুরা গাছ থেকে আসে ১০/১৫ হাজার টাকা। বাড়ীর অন্যান্য ফল থেকেও ভালই আয় হয় তার।
তাল গাছ নিয়ে অনেক উচ্ছাশা সজিব মিয়ার। একবার লাগানোর পর কোন যতœ ছাড়াই বছরের পর বছর ফলন পাওয়া যায়। বজ্রপাত প্রতিরোধে এ গাছের ভূমিকা আছে। গাছের পাতা থেকে হাত পাকা ও চাটাই তৈরি করা যায়। পাকা তাল ছাড়াও কাচা তালের শ^াস খুবই জনপ্রিয়। তাল গাছের রস থেকে গুড়ও সংগ্রহ করা যায়। তবে শ^াসের জন্য কাচা তাল বিক্রিতে আয় কম বলে জানান সজিব মিয়া। যেখানে একটি পাকা তাল বিক্রি হয় গড়ে ৫০টাকা, সেখাকে কাচা তালের দাম হয় গড়ে ২/২৫টাকা। তাই কাচা তাল বিক্রি না করে ভাদ্র মাসে পাকা তাল বিক্রি করলেই লাভ বলে মনে করেন তিনি। একসময় হবিগঞ্জে প্রচুর তাল গাছ ছিল। মাঝে অনেক কমলেও এখন অনেক গাছ লাগানো হচ্ছে। সাবাইকে তাল গাছ লাগানোর অনুরোধ করেছেন সজিব মিয়া।