শিরোনাম
॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ৩ নভেম্বর, ২০২৩ (বাসস) : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, সৈয়দ আসিফ শাহকার পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন নাগরিকত্ব তারই পুরস্কার।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত সুইডিশ বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রী আজ বাসসকে একথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি এটি তার প্রাপ্য। তার বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার প্রত্যাশা পূরণ করা আমাদের দায়িত্ব বলে আমি মনে করেছি। তাকে নাগরিকত্ব দেয়ার মধ্যে দিয়ে একাত্তরে তার অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি দেয়া হলো।”
মোজাম্মেল বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে আমি মনে করি, সৈয়দ আসিফও একজন মুক্তিযোদ্ধা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আবেদন গ্রহণ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ সমর্থককে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব মানুষ নীরবে-নিভৃতে কাজ করেছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন তাদের প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটলো।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানীরা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও জেনোসাইড পরিচালনা করেছে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ এখন তা সঠিকভাবে জানতে পারবে এবং বাংলাদেশের পক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরবে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশের মানুষের ওপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তখন সেদেশেরই একজন নাগরিক হিসেবে সৈয়দ আসিফ বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এটি তার মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের হাত দিয়ে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করায় সৈয়দ আসিফের অবদানের যথাযথ মূল্যায়ণ করা হয়েছে।”
সৈয়দ আসিফ শাহকারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে বাসস থেকে সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে প্রথম প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠন ‘আমরা একাত্তর’ সৈয়দের আবেদনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। পরবর্তীতে সমগ্র কাজটি এগিয়ে নিয়ে যান বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির।
লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বাসসকে বলেন, সৈয়দ আসিফ শাহকার সময়ের সাহসী সন্তান। তিনি একজন মানব প্রেমিক মহান হৃদয়ের অধিকারী। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এদেশের মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো তখন পশ্চিম পাকিস্তানের খুব কম মানুষই গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ অন্যতম। অনেক অত্যাচার ও অবিচার সহ্য করেও তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং সেদেশের গণমানুষের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আবেদন জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য একপর্যায়ে সৈয়দ কারাবরণ করেন এবং নিজ পরিবার থেকেও বিতাড়িত হন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় হলেও তার দেশে তার জন্য পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে সুইডেনে চলে যান। সেখানে থেকেও তিনি সবসময় বাংলাদেশের পক্ষে আন্তরিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করেন। তাকে দেয়া সেই সাইটেশন এবং সনদপত্র আমি নিজ হাতে লিখেছিলাম। এরপর থেকে সৈয়দ আসিফের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
বাংলাদেশের আরেক অকৃত্রিম বন্ধু মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্রিটিশ নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিস সাজ্জাদ জহিরের বন্ধু। জুলিয়ান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে তার প্রয়োজনীয় দলিলাদি তৈরি করে তার স্বাক্ষর নিয়ে কর্নেল জহিরই তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে নাগরিকত্ব প্রদান করেন।
কর্নেল জহির বলেন, এবছরের শুরুতে সৈয়দ আসিফ শাহকার তার নাগরিকত্বের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে একইভাবে তাকে আবেদন করতে বলি। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী সৈয়দের আবেদনের পক্ষে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেন। মন্ত্রী এবং সচিবের স্বাক্ষরিত সেই সারসংক্ষেপটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে এটি অনুমোদন ও স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলে মন্ত্রণালয় থেকে সৈয়দ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ও প্রমাণাদি যাচাই করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম ১ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে এই সনদ স্বাক্ষর করেন।
তিনি বলেন, সৈয়দ আসিফের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পদক আবুল কালাম আজাদ, বিশেষ প্রতিনিধি মাহফুজা জেসমিন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন আমরা একাত্তরের চেয়ারপারসন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান এবং প্রধান সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা হিলাল ফয়েজী। এজন্য তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
তিনি বলেন, এই সমস্ত প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং সচিব ইসরাত চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এটি সম্ভব হয়েছে।
আমরা একাত্তর সংগঠনের পক্ষ থেকে চেয়ারপারসন মাহবুব জামান এবং প্রধান সমন্বয়ক হিলাল ফয়েজী বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক এবং আনন্দদায়ক ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
তারা বলেন, জীবনের অন্তিমে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য তিনি ‘আমরা একাত্তর’ এর কাছে সহায়তা কামনা করেন। আমরা তার পক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ আবেদন জানাই এবং পরবর্তীতে লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির এর বিশেষ প্রচেষ্টায় সৈয়দ আসিফের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ হয়। এই ঘটনাটি অনন্যসাধারণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে এক বড় রকমের নৈতিক জয়।
নেদারল্যান্ডের ডায়াসপোরা সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ (বাসুগ) এর চেয়ারপারসন বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়ার মাধ্যমে সৈয়দ আসিফ বাসস প্রতিনিধি ও আমরা একাত্তরের সাথে যোগাযোগ করেন। তার এই নাগরিকত্ব প্রাপ্তিতে বিকাশ চৌধুরী বড়–য়া বাসসকে বলেন, সৈয়দ আসিফের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পাওয়ার সংবাদে অত্যন্ত ভালো লাগছে। ভালো লাগছে এই ভেবে বাংলাদেশ- প্রেমিক এই অশীতিপর পাকিস্তানী এতে নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করছেন। আমি আনন্দিত এজন্য যে, একাত্তরের দুঃসময়ে তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তার অন্তিম ইচ্ছে পূরণের মাধ্যমে আজ তাকে আমরা যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছি।