বাসস
  ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২:২০

বিজয় : একটি টেবিল ও দু’টি চেয়ারের গল্প

॥ আনিসুর রহমান ॥
ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২ (বাসস) : রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের প্রদর্শনীতে একটি সাধারণ কাঠের টেবিল দৃষ্টি আকর্ষণ করে এমনভাবে রাখা হয়েছে, যা, এক অসাধারণ মূল্যবান স্মারক হিসেবে বাঙালি জাতির স্মৃতির সলতে উসকে দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী হিসেবে ঢাকার অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তকে স্মরণে করিয়ে দেয়।
এই সেই কাঠের টেবিল যার ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজয় স্বীকার করে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয়-সূচক এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল।
খোলা আকাশের নিচে খোলা মাঠে জনসমক্ষে এ ধরনের সামরিক আত্মসমর্পণের ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম হিসেবে বলা হয়ে থাকে।
পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ মঞ্চের পাকিস্তানের শেষ সামরিক কমান্ডার তাদের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অর্থাৎ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।
অনুষ্ঠানটি হয়েছিল খোলা মাঠে। অনুষ্ঠানের জন্য কেবল একটি টেবিল ও দুটি চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সান্ত সিং বাসস-এর প্রতিবেদক আনিসুর রহমানকে ২০১২ সালে জানান। তিনিই সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এর আগ পর্যন্ত কীভাবে তাড়াহুড়ো করে এই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয় বা কাজটি করার জন্য কাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তা অনেকাংশে অজানা থেকে গিয়েছিল।
ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় সিং এই চমকপ্রদ তথ্যটি প্রকাশ করেন। যদিও একটি ঐতিহাসিক পর্বের পটভূমিতে তার বা অন্য কারও জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না।
প্রবীণ এই জেনারেল আরও কয়েকজন বিদেশির সাথে ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা’ গ্রহণের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর স্নেহশীল আচরণ এবং পোশাক-শিখ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যসূচক পাগড়ী ও দাড়ির কারণে তাকে ‘ব্রিগেডিয়ার বাবাজি’ বলে ডাকতেন।
৯৪ বছর বয়সী সিং, স্মরণ করেছিলেন যে সেই সময়, পাকিস্তানি কমান্ডার ঢাকা সেনানিবাসে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডেন্টের জেনারেল স্টাফ চিফ মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকবের সাথে আলোচনায় আত্মসমর্পণ করতে রাজি হওয়ায় তাকে রেসকোর্সে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছিল।
সিং বলেন, ‘আমি চিন্তা করলাম যে 'আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করার জন্য একটি টেবিল ও দুটি চেয়ারের প্রয়োজন হবে। তাই আমি জেনারেল নিয়াজীর অফিসে একটি উপযুক্ত টেবিল ও চেয়ারের জন্য চারপাশে তাকাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘(তারপর) আমি একটি টেবিল দেখতে পাই। এবং দুটি চেয়ারসহ সেটি নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে ছুটে যাই।’
নবতিপর জেনারেল অবশ্য এ প্রতিবেদকের দিকে হাসিমুখে ও কিছুটা বিস্ময়ের ভঙ্গিতে তাকালেন, যেন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফেলে কেন তাকে ‘একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে!
সিং বলেন যে তিনি সাধারণ অস্থায়ী ‘মঞ্চ’ স্থাপন এবং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রেসকোর্সে একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি।
বহু বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কে ফোর্সের কমান্ডার এবং বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বাসস-এর এই সাংবাদিকের সাথে একটি কথোপকথনে বলেন যে বাংলাদেশ-ভারত মিত্র কমান্ড আসলে তাকেই রেসকোর্সের অনুষ্ঠানটি আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
তবে তৎকালীন মেজর শফিউল্লাহ বলেন, ঘটনাস্থলে পৌঁছে ‘আমি দেখতে পাই যে কাজটি ইতোমধ্যেই অন্য কেউ করে রেখেছে’ আর ‘আজ পর্যন্ত (সেদিন) আমি এটি কে করেছে জানি না।’
এই প্রতিবেদক তখন তাকে সিং-এর কাহিনি শোনালেন তখন শফিউল্লাহ মজা করে হাসলেন।
পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘পাকিস্তান কীভাবে ভাগ হলো’ গ্রন্থে এই ঘটনাটি উল্লেখ করেন। আত্মসমর্পণ আলোচনার সময় তিনি ঢাকা সেনানিবাসে উপস্থিত ছিলেন।
এই বই অনুসারে নিয়াজী আলোচনার পর হার মানতে রাজি হওয়ার পরপরই পাকিস্তানি ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরীফের সাথে আলী উঠে দাঁড়ান এবং সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন।
পূর্ব পাকিস্তানে জোনাল সামরিক আইন প্রশাসক এবং গভর্নরের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করা আলী লিখেছেন, ‘আমরা লক্ষ্য কছি যে ভারতীয়রা কিছু চেয়ার ও একটি টেবিল খুঁজছে। আমরা বুঝতে পারি যে তারা একটি অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করতে চায়।’
দুইবার ভারতের শীর্ষ বীরত্ব পুরস্কার মহা বীর চক্র (এমভিসি} প্রাপ্ত সিং বলেন যে তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পরপরই গোয়েন্দা প্রয়োজনীয়তার সাথে সঙ্গতি রেখে নিয়াজীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন।
সিং বলেন, ‘সামরিক প্রয়োজন বা নিরাপত্তার কারণে ... তার নিয়াজীর সৈন্যদের অবস্থান, তাদের পূর্বের পরিকল্পনা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে সেই সন্ধ্যায় আমাদের তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়।’
তিনি বলেন, পরে নিয়াজিকে ভারতীয় সেনারা তার বাসভবনে নিয়ে আসে এবং দ্বিতীয়বারের মত তার সাথে কথা বলার প্রয়োজনে আমিও তার বাড়িতে (ক্যান্টনমেন্টে) যাই।
তিনি বলেন, ‘আমি ৩০ জন ভারতীয় সৈন্যকে বাড়িটি পাহারা দেওয়ার জন্য মোতায়েন করি... আগের রাতে বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সামরিক অফিসার বার্মার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম যে নিজেও পালাতে পারে।’
সিংকে দেওয়া বাংলাদেশের সম্মাননার শংসাপত্রে উল্লেখ করা হয় যে ১৯৭১ সালে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর এফজে সেক্টরের কমান্ডার হিসাবে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে ‘বাবাজি’ বলে ডাকতেন। তিনি এদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন।
প্রশংসাপত্রে বলা হয়, ‘ময়মনসিংহ দখল করার পর তিনি মধুপুর হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পৌঁছান। তিনি সর্বদা তার সৈন্যদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন।’
সিং অবশ্য বাসসকে বলেন যে তার জন্য সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল ঢাকার মুক্তি। তার ভাষায় ‘এটি আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন’।
প্রশংসাপত্রে ঢাকাকে মুক্ত করার সময় তার সাহসিকতা ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সিং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও মধুপুর দখল করার পরে দ্বিতীয় এমভিসি পুরস্কৃত হন। এই যুদ্ধে তিনি শত্রুর দুটি ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে মাত্র একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের পরাস্ত করেন।