শিরোনাম
॥ ইফতেখারুল অনুপম ॥
টাঙ্গাইল, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ (বাসস): ‘বন্যপ্রাণী হত্যা করা, আহত করা দন্ডনীয় অপরাধ। সাবধানে গাড়ী চালান, বন্যপ্রাণীর অবাধ চলাচল নিশ্চিত করুন। নির্দেশক্রমে টাঙ্গাইল বনবিভাগ।’ জনসাধারণ, পথচারী, গাড়ী চালকসহ সকলের দৃষ্টি আর্কষণ করে এমন সচেতনতা বিষয়ক সাইনবোর্ড টানানো রয়েছে টাঙ্গাইল বন বিভাগের জাতীয় উদ্যানের মুল ফটকসহ বনের বিভিন্ন স্থানে। যা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী জনসাধারণ ও গাড়ী চালকদের চোখে পড়ার জন্য যথেষ্ট।
এরপরও গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রায়ই প্রাণ হারাচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনের বানর, হনুমানসহ বন্যপ্রাণীরা। আহতও হচ্ছে এসব প্রাণী। গাড়ির হর্ণ আর শব্দ দূষনে বিপর্যস্ত মধুপুর বনাঞ্চলের বন্য প্রাণীরা। ব্যাহত হচ্ছে তাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্যপুর্ন পরিবেশে নির্বিঘেœ চলাচল আর বসবাস। শব্দ দূষনের বিরুপ প্রভাবে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বন্যপ্রাণীদের অবাধে চলাচল নিশ্চিত করণের জন্য বন্যপ্রাণী আইন মেনে চলা ও সচেতনতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।
দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল মধুপুর শালবন। এই শালবন নানা ঐতিহ্যের কারণে বিখ্যাত। শালবৃক্ষ নানা বৈচিত্র্যময় গুল্মলতা, ভেষজ উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী, পাখি, ভূ-বৈচিত্র্য, প্রকৃতি, পরিবেশ, মাটিসহ সমতল এলাকার এ বনের ঐতিহ্য ও পরিচিতি দেশজুড়ে। দেশের বাইরেও রয়েছে এ বনের খ্যাতি। আশির দশক থেকে এই বন সংকুচিত হতে শুরু করলে কমে যাচ্ছে বন্য পশুপাখিও।
এখনো পর্যাপ্ত অবশ্য পরিমাণে রয়েছে কালোমুখ হনুমান ও বানর, কাঠ বিড়ালী, গুইসাপ, বেজি, শিয়াল, বন মোরগসহ বিভিন্ন ছোট-বড় পশুপাখি। তবে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বানরের সংখ্যা একটু বেশি। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রসুলপুর থেকে শুরু করে পঁচিশ মাইল পর্যন্ত বনের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা রাস্তার পাশে বিভিন্ন স্থানে দলবদ্ধভাবে চলাচল করে বানর।
খাদ্যের সন্ধানে দলবেঁধেই রাস্তা পারাপার হয়ে থাকে। এই বন্যপ্রাণীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জনসাধারণ, গাড়ী চালকসহ সকলের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য বনের বুক চীরে বানানো রাস্তার দর্শনীয় স্থানে এমন সাইন বোর্ড টানিয়ে দিয়েছে বন বিভাগ।
তবে এতে কোন কাজ হচ্ছে না। সর্তকীকরণ সাইন বোর্ডের নির্দেশনা মানছে না ভ্যান-রিকসা, মোটরসাইকেল, সিএনজি, অটোবাইক, ট্রাক ও বাসের চালকরা। আইন না মানায় গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে হরহামেসাই প্রাণ হারাচ্ছে কিংবা আহত হচ্ছে বন্যপ্রানী।
সারেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে মধুপুর বনের মুনার বাইদের একটু আগেই দেখা গেল রাস্তার উপর পড়ে আছে গাড়ীর চাকায় পিষ্ট হয়ে মরে যাওয়া একটি বানর। পথচারীরা জানান, একটু আগে গাড়ীর ধাক্কায় মারা গেছে বানরটি। মরা বানরটির চারপাশে ঝোপঝাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বানরের দল। চিকচিক খেক খেক শব্দে আহাজারি করছে তারা। বানরের দল নিহত বানরটির কাছে আসার চেষ্টা করেও আসতে পারছে না। কারন রাস্তায় অবিরাম চলাচল করছে বিভিন্ন যানবাহন।
সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, মাঝে মধ্যেই বেপরোয়া গতির গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে এভাবেই প্রাণ হারাচ্ছে বন্যপ্রাণীরা। এমন সচেতনতামুলক সাইন বোর্ডেও কমছে না বন্য পশুপাখির প্রাণহানী। যথাযথ আইন প্রয়োগ করে মধুপুর বনের বন্যপ্রাণী রক্ষা করা জরুরি বলে মনে করে সাধারণ মানুষ। তা না হলে এভাবে বন্যপ্রানী মৃত্যুর ঘটনা আরো বাড়বে বলেই মন্তব্য করেছেন তারা। ফলে কমে যাবে পরিবেশের ভারসাম্য, বিপন্ন হবে প্রকৃতি।
পরিবেশ রক্ষা সোসাইটির টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভাপতি লিয়াকত হোসেন জনি বলেন, বন্যপ্রানীরা খাদ্যের সন্ধানে রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে অনেক সময় বেপরোয়া গতির গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। বন্যপ্রাণীদের প্রতি চালকদের আরো সদয় হওয়া প্রয়োজন। যথাযথ আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতাই পারে এটি রোধ করতে।
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, রসুলপুর পর্যন্ত বন এলাকার পঁচিশ মাইল রাস্তায় প্রায় সময় দেখা যায় শিয়াল, গুইসাপ, সাপ, হনুমান, বানরসহ নানান প্রজাতির বন্যজীবজন্তু চলন্ত গাড়ির আঘাতে মারা যাচ্ছে। উন্নত দেশে রাস্তার পাশে বন্যপ্রাণীদের জন্য নেটের বেড়া দেয়া হয়। এভাবে বেড়া দিয়ে, আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতার মাধ্যমে বন্যপ্রাণীকে দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, জীববৈচিত্র্য এবং বন্যপ্রাণী আইন মানা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। বন্যপ্রাণী হতাহত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নিবে। যানবাহনের বনের ভিতর দিয়ে চলাচল করতে হলে আইন মেনে চলতে হবে। আইনের অমান্য করলে বিধি মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধে দন্ডিত করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে মধুপুর জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, দ্রুত গতিতে গাড়ি চলাচলের কারণে বন্যপ্রাণীরা নিরাপদ দুরত্বে থাকতে পারে না। ফলে প্রাণ হারায়। বনের ভেতরে চলাচলের সময় গাড়ির গতিসীমা কমিয়ে গাড়ি চলাচল করা উচিত। আইন মেনে চললে বন্যপ্রাণীরা নিরাপদ থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।