বাসস
  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:২৫

ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে ফেনী ছিল অগ্নিরূপে

॥ আরিফ রিজভী ॥
ফেনী, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ (বাসস): রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গণআন্দোলন দমনে পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হতে পূর্বপাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করে। এতে ঢাকার মতো ফেনীতেও ছাত্র আন্দোলন ফুঁসে ওঠে। 
এদিন ফেনীতে মিছিল-মিটিংসহ ভাষার দাবিতে কর্মসূচি দেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। একই কর্মসূচি দেয় ফেনী কলেজ ছাত্র মজলিস (বর্তমানে ছাত্র সংসদ)। এদিন ফেনীতে ছাত্রদের উদ্যোগে মিছিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয় (বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ফেলে আসা সেইসব দিনের কথা, ২০১৬, পৃ-৫৭)।
বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ফেনীতেও হরতার-ধর্মঘট পালিত হয়। তৎকালীন যুব সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও নোয়াখালী জেলা সভাপতি খাজা আহমদের নেতৃত্বে ফেনী শহরে মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ফেনীর এই সংগঠনটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে আলোচিত (বদরুদ্দীন উমর, পূর্ববঙ্গ ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি)। খাজা আহমদের অন্যান্য সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন, এমএস হুদা, কুমুদ দত্ত, রফিক উদ্দিন এন্তু মিয়া, সৈয়দ আহমদ, একে শামসুল হুদা, এমএ জলিল, সিরাজুল হক মজুমদার, আবু বকর সিদ্দিক, বেচু মিয়া, এমএ কাশেম, ডা. সৈয়দ তোফাজ্জল হোসেন, ডা. মুহাম্মদ এছাক, শ্রীধাম দাস, সুজাত আলি, রমজান আলি, নুরুল হুদা প্রমুখ (ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস, পৃ-১৫০)।
একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক আত্মজীবনীতে বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি এবং ভাষাশহীদদের কথা ফেনীতে পৌঁছে সেদিন রাতে। ভাষাশহিদ সালামের আহত হওয়ার কথা তখনো কেউ জানত না। এরপরই ফেনী কলেজের ছাত্ররা রাতেই মিছিল বের করে শ্লোগান দিতে থাকে। খাজা আহমদ তার অনুসারিদের নিয়ে গণআন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলন ফেনী মহকুমার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সকালে খাজা আহমদ, ফেনী কলেজ ছাত্র মজলিস সম্পাদক জিয়াউদ্দিন, আমীর হোসেন প্রভৃতি ছাত্রনেতারা ফেনী থেকে একটি জিপ গাড়িতে মাইক লাগিয়ে পথে-পথে সভা করতে করতে চৌমুহনী পৌঁছে।...আমরা সেখানে ছাত্র-জনতার এক সভায় বাংলা ভাষার দাবিতে বক্তব্য পেশ করি। এদিন জিয়াউদ্দিনকে আহবায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। এ আন্দোলনের পর খাজা আহমদ, ডা. তোফাজ্জল হোসেন, ফেনী কলেজ ছাত্র ফরমান উল্যাহ খান, আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ছাত্র গ্রেফতার হন (পৃ-৫৭)। বিচারপতি কাজী এবাদুল হক পুনর্গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন।
এসময় ঢাকায় ফেনীর বেশ কয়েকজন সন্তান আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। তাঁদের সাথে ফেনীর নেতাদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ফলে ভাষা আন্দোলন চলাকালে (১৯৪৮-১৯৫৬) ফেনী ছিল ভাষা আন্দোলনের অগ্নিরূপ। ১৯৫২ সালে ঢাকায় এসব ব্যক্তিদের মধ্যে গ্রেপ্তার হন সাংবাদিক আবদুস সালাম, হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ নুরুল হুদা, শহীদুল্লা কায়সার, ইউনুস চৌধুরী (ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস, পৃ-১৪৯)।
ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস বইতে জমির আহমেদ তাঁর ফেনী শীর্ষক লেখায় ২২ ফেব্রুয়ারি ফেনীর চিত্র তুলে ধরেন-
"২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র মিছিল, ধর্মঘট ও সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। রাতে ফেনীতে খবর পৌঁছে যে রাজধানী ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়েছে। এ খবরের প্রেক্ষিতে পরদিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গাছগাছালি ও লতাপাতা ঘেরা সবুজ-শ্যামল ও শান্ত ফেনী জনপদ হঠাৎ রুদ্ররূপ ধারণ করে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। 'ছাত্র হত্যার বিচার চাই', 'খুনী নুরুল আমিনের কল্লা চাই' স্লোগানে ফেনী শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। এমনকি ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ও ফেনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও রাস্তায় নেমে পড়েন। ওইদিন ফেনী জামে মসজিদে জুমার নামাজের পর ঢাকায় নিহত ছাত্রদের আত্মার মাগফেরত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। বিশিষ্ট কথাশিল্পী আবদুস শাকুর বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে ফেনীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন-
ফেনী ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী দুর্গ। আমি গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার জন্য ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় ফেনীর উদ্দেশে যাত্রা করি। গরুর গাড়ি করে দাগনভূঞা পর্যন্ত পৌঁছে যাত্রাবিরতি হয়। সেখানে লোকজন রাস্তায় জমায়েত হয়ে স্লোগান দিচ্ছে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'খুনী নুরুল আমিনের কল্লা চাই', 'ছাত্র হত্যার বিচার চাই'। তখন জানতে পারি পুলিশের গুলিতে ঢাকায় কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়েছেন। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে ধর্মঘট চলছে। স্থানীয় লোকজনের মুখে জানতে পারি আমার পক্ষে ফেনী হয়ে ঢাকা যাতায়াত দূরের কথা, দাগনভূঞা থেকে ফেনী পর্যন্ত পৌঁছাও সম্ভব নয়। অতঃপর আমি নিজ গ্রামে ফিরে যাই।"
জমির আহমেদ আরও উল্লেখ করেন, "ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ফেনীর মারমুখী ছাত্র-জনতা ফেনীতে রেলপথের অবরোধ সৃষ্টি করে। ফেনীর মানুষের সংগ্রামী রূপ দেখে কর্তৃপক্ষ হয়ে পড়ে বেসামাল। তাই তারা শুরু করে নির্যাতন ও জুলুম। জননিরাপত্তা আইন নামে পরিচিত কুখ্যাত কালাকানুনে ভাষা আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং শহরে তল্লাশি শুরু হয়। ফেনী কলেজের ছাত্রনেতা জুলফিকার হায়দার চৌধুরী, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, লুৎফুর রহমান ভানু, এম.এ. হানিফ, ফরমান উল্লাহ, যুবলীগ নেতা খাজা আহমদ, এ.কে. শাসমুল হুদা, এম.এ. কাশেম, কংগ্রেস নেতা কুমুদ দত্ত প্রমুখ জননিরাপত্তা আইনের শিকার হন এবং নির্যাতন ভোগ করেন।"
ওই বছর ১ মার্চ দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল ফেনীর তৎকালীন পরশুরাম থানায় ২১ ফেব্রুয়ারির বিশাল ছাত্র সমাবেশের ঘটনা। এতে উল্লেখ করা হয়, "ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মন্ত্রীসভার পদত্যাগ এবং জুলুমের স্থায়ী প্রতিকারের দাবীতে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের ছাত্রগণ ও জনসাধারণ পূর্ণ হরতাল পালন করে। তাহারা বিরাট শোভাযাত্রা বাহির করিয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।"
২০ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবিতে সোনাগাজীতে সভা অনুষ্ঠিত হয় বলে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন শিক্ষাবিদ মরহুম কামাল হাসান চৌধুরী। এদিন বাংলা ভাষা বিরোধীদের হামলায় ১৫/২০ জন আহত হয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ধলিয়া স্কুল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সদস্যরা ফেনী-সোনাগাজী সড়ক অবরোধ করে। উল্লেখ্য, কামাল হাসান চৌধুরী এ সংগঠনের সহ-সম্পাদক ছিলেন। সাবেক এমপি তালেব আলী ছিলেন সম্পাদক।