বাসস
  ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:১৭

দিনাজপুরের চিনিরবন্দরে গড়ে উঠেছে চুল প্রক্রিয়াজাত করণ কারখানা

দিনাজপুর, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ (বাসস): জেলার চিরিবন্দর উপজেলায় নিজ উদ্যোগে গড়ে
উঠেছে  চুল প্রক্রিয়াজাত করণ কারখানা। এসব কারখানার   প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ  শ্রমিকের
কর্মসংস্থান হওয়ায় কাজ করে  তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন ।
সম্প্রতি সরজমিন অনুসন্ধান করে জানা যায, দিনাজপুর  চিরিরবন্দর উপজেলার রানীবন্দর বাজার এলাকায় প্রায় শতাধিক চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কাজ করা নারী শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নারী শ্রমিকেরা দিন হাজিরার ভিত্তিতে গুটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কারের কাজ করে থাকেন। এতে তারা  দিন হাজিরা পেয়ে থাকেন ১২০ টাকা। সেই হিসেবে একজন নারী শ্রমিক মাসে এ কাজ করে আয় করেন ৩ হাজার ৬০০ টাকা। তবে একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতন ১৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে ।
নারী শ্রমিকেরা বলেন, বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী এ মজুরি দিয়ে তাদের জীবন চলছে।  তারা সংসারের অভাব দূর করতে কাজ করেছেন  ।
এ কাজে অভিজ্ঞ নারী শ্রমিক রাশেদা বেগম জানান , এ গুটি চুল প্রথমে নারী  শ্রমিকের মাধ্যমে গুটি ছাড়িয়ে আলাদা করে প্রাথমিক পরিষ্কার এবং বাছাই কাজ করা হয়। এরপর এ বাছাই করা চুলগুলো ডিটারজেন্ট পাউডার ও শ্যাম্পু দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয়বারের মতো পরিষ্কার করা এ চুল কারখানার ভেতরে নিয়ে কাটিং মেশিনের মাধ্যমে কাচি করা হয়। কাচি করা চুলগুলোকে একইসঙ্গে রাবার দিয়ে ছোট ছোট গোছায় বেঁধে আলাদা করা হয়। কারখানায় এ ছোট  গোছা করা চুলগুলোকে বলা হয় লাচি।
এবার এ লাচি করা চুল পুনরায় শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করে ধুয়ে বাতাসে শুকানো হয়। শুকিয়ে চুল যখন উজ্জ্বল হয় তখন এগুলোকে শেষবারের মত কাটিং মেশিনে নেওয়া হয় ফিতা দিয়ে মেপে গ্রেডিং করে রেমি তৈরির জন্য। এ রেমি করা চুল কারখানা থেকে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয় । এরপর কারখানা মালিকেরা নিজেরাই ঢাকায় গিয়ে চুল বিক্রি করেন । রেমি প্রক্রিয়াজাত করণ চুলের দৈর্ঘ্যের উপরই এর মূল্য নির্ভর করে। চুল যত লম্বা হবে বাজার মূল্য  তত বেশি হবে। চুলের এ দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে এর বাজার মূল্য সর্বনি¤œ ৬ ইঞ্চি চুল ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২থেকে ৩২ ইঞ্চি সাইজের চুল প্রতিকেজি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২২ ইঞ্চি থেকে ৩২ মাপের লম্বা চুলকে সর্বোচ্চ গ্রেডের চুল বলা হয়।
(দনাজপুর রিরিরবন্দর উপজেলায় রানীর বন্দর এলাকায় একটি কারখানায় নারী শ্রমিকরা চুল বাছাই এর কাজ করছেন।)
রানীর বন্দর বাজারে কারখানার মালিক রশিদুল ইসলাম জানান , তার  নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা এ চুল প্রক্রিয়াজাত করণ কারখানাসহ এ এলাকায় গড়ে ওঠা শতাধিক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায়   প্রায় ১০ হাজার নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের   কর্মসংস্থানের সুযোগ  সৃষ্টি করেছে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এ খাতে বিনিয়োগ করছে। ফলে ছোট একটি খাত হলেও সেটি ধীরে ধীরে দেশের  অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে  ।
নারী শ্রমিক সুফিয়া  খাতুব  বলেন, আমাদের এলাকায় এখন অনেক চুলের কারখানা। আমরা গরীব মানুষ দিন আনি দিন খাই। বাসায় বসে না থেকে এখানে চুলের কাজ করি। সারাদিন কাজ করে ১২০ টাকা পাই। মাসে ৩০ দিন কাজ করলে ৩ হাজার ২০০ টাকা পাই। বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম বেশি কিন্তু আমাদের মত নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।  
আরেক নারী শ্রমিক শহীদা  বানু  বলেন, আমরা মেয়েদের মাথা থেকে পড়ে যাওয়া  চুলের কাজ করি। এ চুলগুলো জটলা লেগে থাকে, সেগুলো আমরা কাটা দিয়ে আস্তে আস্তে খুলি।
তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল বেলা বাড়ির কাজ করে সকাল ৮ টার দিকে কারখানা আসি। আবার নাস্তার জন্য ১০টার সময় ৩০ মিনিট ছুটি পাই। নাস্তা খেয়ে আমারা  কাজ শুরু করি।   দুপুর হলে খাবারের জন্য আবার ১ ঘণ্টা সময় পাই। এর পরে বিকেল  ৫টায় ছুটি দেয।   আমরা দিন  ১২০ টাকা মজুরি পাই। এ টাকা দিয়ে সংসার চালায়।
চুলের মিস্ত্রী জমির আলী   বলেন, আমি মানিকগঞ্জ  থেকে এখান এখানে কাজ করতে আসছি। প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করতে পারি।
চুলের কারখানার মালিক মতিয়ার  রহমান বলেন, আমি  বেকার ছিলাম। গ্রামে ফেরি করে সংসার চালাতাম। তখন চুল সংগ্রহ করে সৈয়দপুর বেহারিদের কাছে বিক্রি করতাম। তাদের কাছ থেকে সব কিছু শিখে আমি শুরু করেছি চুলের কাজ। আমার কারখানায় ৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এ চুল কারখানায় চুলের সংকট ঠিক মত চুল পাওয়া যায় না। শ্রমিকদের অল্প মজুরি দিয়ে কাজ করার পরে আমাদের পোষায় না। সরকার যদি আমাদের  অন্য  দেশ থেকে চুল আমদানি করতে দিতো।  তাহলে আমাদের মত ছোট চুল ব্যবসায়ীরা লাভবান হতো।
কারখানার মালিক সিরাজুল  ইসলাম  বলেন, ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে মেয়েদের মাথার ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করি। তারা সেগুলো বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। আমরা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে এক কেজি চুল ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করতে হয় । ওই চুল কারখানার নারী শ্রমিকদের দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করণ করি। সেই চুল ছোট বড় সাইজ অনুযায়ী ৬ হাজার থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত ১ কেজি চুল বিক্রি করি। তবু আমাদের লাভ হয় । কারখানায় ৩০ থেকে ৪০ জন শ্রমিক কাজ করে তাদের  মজুরি ১২০ টাকা করে দিন দিতে হয়। আবার চুলের মিস্ত্রীদের মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পায়।
নারী উদ্যোক্তা ও চিরিরবন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান  লায়লা বানু বলেন, আমাদের উপজেলায় শাতাধিকের বেশি চুল প্রক্রিয়াজাত করণ কারখানায় ১০ হাজারের বেশি নারী শ্রমিক চুলের কাজ করেন।  তাদের মজুরি প্রতিদিন  ১২০ টাকা। এ সময় ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে একটা মানুষের সংসার কীভাবে চলবে। কারখানাগুলোতে চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে লাভবান হচ্ছে ।  কিন্তু নারী শ্রমিকরা   সারাদিন কাজ করে কোনো রকম চলছে। আমি নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার  ব্যবস্থা করতে কারখানার মালিকদের বলেছ। নারীদের মজুরি বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।