শিরোনাম
॥ মাজহারুল আলম মিলন ॥
পীরগঞ্জ (রংপুর), ১০ মার্চ, ২০২৪ (বাসস): রংপুরের পীরগঞ্জে কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিএমডিএ’র বিভিন্ন উন্নয়নমূখী প্রকল্প। বিএমডিএ’র নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের সুবিধা ভোগ করে অনাবাদি জমিতে বিভিন্ন ফসলের চাষসহ আবাদি জমিতে এক ফসলের স্থলে ২/৩ ফসল উৎপাদন, রবিশস্য উৎপাদনসহ কৃষকের পরিশ্রম লাঘবের পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে খরচ কমে যাওয়ায় কৃষকদের ভাগ্য বদলে গেছে। পাশাপাশি জেলে পরিবারগুলো বিএমডিএ’র বিভিন্ন উন্নয়নে সুবিধা ভোগ করে জীবনমান পাল্টে নিয়েছে।
বিএমডিএ পীরগঞ্জ জোন অতিরিক্ত সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে পীরগঞ্জ উপজেলায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) কার্যক্রম আরাম্ভ হয়। চলতি বছর পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে এ উপজেলায়। এতে কৃষক, জেলেসহ উপজেলার সকল শ্রেণী পেশার মানুষ সুবিধা ভোগ করছে। বিএমডিএ’র প্রায় ৩৩ কোটি ৬৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্য রয়েছে ৭৭টি অচালু গভীর নলকুপ সচলকরণে ৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫ হাজার, নতুন করে ২০টি গভীর নলকুপ স্থাপনে ২কোটি ৪০ লাখ, ৩৫ হাজার ৩০ মিটার ভূ-গর্ভস্থ সেচ নালা নির্মাণে ৩ কোটি ৪৫ লাখ, সেচযন্ত্রে বিদ্যুত ব্যবহৃতে ২৩ কিলোমিটার ১১ কেভি বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ ও সংযোগে ১ কোটি ২৭ লাখ, ১১৭টি সেচযন্ত্রে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে ৪৬ লাখ ৮০ হাজার, উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের পানবাজার থেকে কুমেদপুর ইউনিয়নের রসুলপুর বাজার পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার আখিরা খাল, ভেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের সোনামতি ব্রীজ থেকে বিশলা গ্রাম পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সোনামতি খাল, চতরা ইউনিয়নের ঘাষিপুর থেকে কাবিলপুর ইউনিয়নের মানষি ফরিদপুর পর্যন্ত ৮.০১৮ কিলোমিটার চতরা খাল, শানেরহাট ইউনিয়নের শিমুলিয়া ব্রীজ থেকে মিঠিপুর ইউনিয়নের হাসানপুর পর্যন্ত নলেয়া নদী খাল পুন:খনন ১৯.২৬৪ কিলোমিটারসহ ৩৫কিলোমিটার খাল খননে ৯ কোটি ৩২ লাখ, ১৪টি নদীতে বৈদ্যুতিক এলএলপি স্থাপনে ১ কোটি ৬৮লাখ, ৬টি নদীতে সোলার এলএলপি স্থাপনে ১ কোটি ৮হাজার, ৯টি সোলার পাতকুয়া স্থাপনে ১ কোটি ৩৫ লাখ, ১টি ফুট ওভার ব্রীজসহ খালে ড্যাম নির্মাণে ৭৫ লাখ, ২টি খালে ফুট ওভার ব্রীজ নির্মাণে ৬০ লাখ, ৭টি খাস মজা পুকুর পুন:খননে ১ কোটি ৫ লাখ, ৩টি পুকুর ঘাট নির্মাণে ৮ লাখ, পীরগঞ্জ জোনাল অফিস ভবন নির্মাণে ১ কোটি ৫ লাখ, ১১৭টি সেচযন্ত্রে ডিজিটাল প্রিপেইড মিটার স্থাপনে ১ কোটি ৫ লাখ, কৃষক পর্যায়ে ৭০০টি ডিজিটাল স¥ার্ট কার্ড বিতরণে ৫১ লাখ, ৩টি বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ স্থাপনে ১ কোটি ৬ হাজার, ১ লাখ ৩৭ হাজার ২০০টি ফলজ, বনজ, ওষুধী, তালবীজ ও কাজুবাদাম বৃক্ষরোপনে ৬৬ লাখ, বিভিন্ন মওসুমে কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ৩২টন বীজ সরবরাহে ৯৬ লাখ, ৮শ’ জন আদর্শ কৃষক প্রশিক্ষণে ৬ লাখ ব্যয়সহ ৩৩ কোটি ৬৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
চতরা ইউনিয়নের কাটাদুয়ারে নির্মিত ফুট ওভার ব্রীজে কাটাদুয়ার, ইকলিমপুর, সুরানন্দপুর, চন্ডিদুয়ারসহ ৮টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কৃষিপণ্য পরিবহন সহজতর হয়েছে। কাবিলপুর ইউনিয়নের মানষি ফরিদপুরে ক্রস ড্রামসহ ফুট ওভার ব্রীজে ২টি উপজেলা পলাশবাড়ি ও পীরগঞ্জের মানুষের চলাচলে সেতুবন্ধন ও কৃষিপণ্য সরবরাহে ব্যাপক সুবিধা মিলেছে।
বড় বদনাপাড়া গ্রামের মানিক, মন্জু, হলদিবাড়ি গ্রামের সাজু, জাবেদ আলী জানান, মানষি ফরিদপুরে ক্রস ড্রামসহ ফুট ওভার ব্রীজ নির্মাণের ফলে ২ উপজেলাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পুরণসহ আত্বীয় স্বজন, ব্যবসা বাণিজ্যে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পলাশবাড়ি উপজেলায় গিয়েছি, এখন মাত্র ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সহজে স্বল্প সময়ে পলাশবাড়ি পৌঁছানো যায়।
পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাট, পাঁচগাছি ও মিঠিপুরসহ মিঠাপুকুরের হযরতপুর ও পাশর্^বর্তি ২টি ইউনিয়ন দিয়ে বয়ে চলা নলেয়া নদী খাল খননে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় প্রায় সময়ে ডুবে থাকা ৮৫০ হেক্টর জমি এখন ২/৩ ফসলি জমিতে রুপান্তরিত হয়েছে।
ওই এলাকার কৃষক পার্বতিপুরের বেলাল, দামোদরপুরের সাইফুল কাজি, মেষ্টা গ্রামের সাজু, পাহাড়পুর গ্রামের আব্দুল জলিল জানান, নলেয়া খননে দীর্ঘদিনের দাবি পুরণ হয়েছে। আমারা পীরগঞ্জের এমপি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী’র প্রতি কৃতজ্ঞ। আগে জমি থেকে ফসল ঘরে উঠতো না, প্রায়ই জমিগুলো পানিতে ডুবে থাকতো। আমন মওসুমে জমিতে আবাদকৃত ধান ঘরে উঠতো না, এমনকি গবাদি পশুরও খাবার অনুপযোগি ছিল। কষ্টে ছিলাম, এখন শান্তিতে আছি। জমিগুলো ২/৩ ফসলি জমিতে রুপান্তরিত হয়েছে।
ওই এলাকার মাছ শিকারী জেলে মেস্টা গ্রামের যতীন, খামার সাদুল্যাপুরের বানেশ^র, পাহাড়পুর গ্রামের ননী জানান, এখন নিয়মিত নলেয়া নদীতে মাছ শিকার করে সেই মাছ শানেরহাট ও মাদারগঞ্জ বন্দরে বিক্রি করছি। আগের চেয়ে সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে, পরিবার নিয়ে সুখে আছি।
এছাড়াও উপজেলার করতোয়া নদীর বালুচর এখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে। বরেন্দ্র এলাকায় সবজি চাষে নীরব বিপ্লব ঘটছে। শত শত কৃষক সবজি চাষে ঢেকে ফেলেছে নদীর বালুচর। ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন বোরো ধানসহ কাঁচামাল সবজি চাষে উৎসাহী হয়েছে কৃষকরা।
চরাঞ্চল এলাকার কৃষক কুয়েতপুর হামিদপুর ইমরান, শামীম, আলিম, ছাবু জানান, কয়েক বছর ধরে ধান, ভুট্টার পাশাপাশি সবজির চাষ শুরু করেছি। ফলে করতোয়া নদীর বালুচর এখন সবজির দখলে। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে সবজি এখন বড় বড় মোকামে পাঠানো হচ্ছে। এতে ক্রমেই লাভবান হয়ে উঠছেন ওই এলাকার কৃষকরা। একসময় বালুচরে কোন আবাদ হতো না। বিএমডিএ’র এলএলপি ভাসামান সেচ পাম্পগুলো করতোয়া নদীতে স্থাপন করে অল্প খরচে প্রয়োজন মতো পানি সেচ দিয়ে যাচ্ছে। চাষিরা সুবিধা পেয়ে ধান, ভুট্টা, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, মুলা, আলু, মরিচ, টমেটো, বেগুন, করলা,পটলসহ সব ধরনের ফসল চাষে পাল্টে গেছে করতোয়া এলাকার চিত্র। এছাড়াও সবজি চাষাবাদ করে কৃষক লাভবান হওয়ায় পাশাপাশি সবজি চাষের উৎপাদন বেড়েছে এবং সবুজ বিপ্লব ঘটেছে করতোয়া নদীর তীরবর্তী এলাকায়।
চতরা এলাকার নেংড়ার ঘাট সংলগ্ন বিএমডিএ'র সেচ পাম্পের অপারেটর সাবু, শামিম, আলিম বলেন, বালু চরে আগে ডিজেল চালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে কৃষক জমিতে পানি সেচ দিতেন। এতে করে সময় ব্যয় ও খরচের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারনে এলএলপি'র সেচ পাম্পগুলোর উপর ভরসা রাখছেন। বিএমডিএ'র সাথে যে সকল চাষি কৃষি ফসল ফলাছেন, তারা সকলেই অনেক সুবিধা পাচ্ছেন।
বিএমডিএ’র পীরগঞ্জ জোনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু সুফিয়ান জানান, উপজেলার কৃষি জমিতে বিএমডিএ'র ৯৭টি গভীর নলকূপ কৃষি জমিতে পানি সেচ সরবরাহ করে আসছে। এছাড়াও করতোয়া নদীর তীর এলাকায় এলএলপি'র ভাসামান সেচ পাম্প সোলার ৬টি ও বৈদুতিক ১৪ টিসহ মোট ২০টি পাম্পে চাষিরা কৃষি জমিতে পানি সেচ দিয়ে আসছে। এছাড়াও ৬টি বিদ্যুত সংযোগের অপেক্ষাসহ আরও ৫টি এলএলপি সেচ পাম্পের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পীরগঞ্জ আসনের এমপি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। বিশেষ করে কৃষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসর্ম্পুণ। কৃষক, জেলেসহ পীরগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শীঘ্রই পীরগঞ্জকে স্মার্ট উপজেলা হিসেবে তৈরী করা হবে। এখানে কোন শ্রেণী পেশার মানুষ পিছিয়ে থাকবে না। ফলে সকলে সুসমভাবে সরকারের উন্নয়ন সুবিধা ভোগ করবে।