শিরোনাম
॥ হায়দার হোসেন ॥
গোপালগঞ্জ, ২০ এপ্রিল. ২০২৪ (বাসস): আজকাল সরকারি চাকরি সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দালাল বা দালালি ছাড়া যে বর্তমান সময়ে সরকারি চাকরি নামের এ সোনার হরিণটি কেউ ধরতে পারেনা তা প্রায় সবাই জানে। তবে এবার কোন ধরনের দালালি বা ঘুষ ছাড়া, নিজ যোগ্যতায় জেলা প্রশাসনের ইউনিয়ন পরিষদ সচিব পদে নিয়োগ দিয়ে এ কথাটিকে মিথ্যে প্রমাণ করেছে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের ক্ষুদে ব্যবসায়ী রামচরন ঘরামী। তার ছোট সন্তান লিপিকা ঘরামীকে লেখাপড়া করিয়েছেন বেশ কষ্টে। ২০১৮ সালে গণিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরীর জন্য আবেদন করা শুরু করেন লিপিকা। ইতোপূর্বে পাঁচবার পরীক্ষার টেবিলে বসলেও কোন বারেই চাকরী নামক সোনার হরিণটির কাছাকাছি যেতে পারেননি। এবার মাত্র ৫০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফট জমা দিয়ে কোন প্রকার ঘুষ ছাড়াই নিজ যোগ্যতায় চাকরী পেলেন এ নারী।
লিপিকা ঘরামী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন,দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় লেখা পাড়া শিখেছি বেশ কষ্ট করে। চাকরীর জন্য বড় অংকের টাকা খরচ করা আমার পরিবারের জন্য অসাধ্য ছিল। তাইতো এতোদিন চাকরীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। আজ সকল প্রতিকুলতাকে পিছনে ফেলে মাত্র ৫০০টাকা খরচ করে আমি চাকরী পেয়েছি। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু মাত্র স্বচ্ছ নিয়োগ পরীক্ষার কারনে। এক একটি স্বচ্ছ নিয়োগ শুধু এক একটি পরিবার নয় একটি দেশকে বদলিয়ে দিতে পারে । দেশে স্বচ্ছাতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমি এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। শুধু লিপিকা ঘরামী নয় এরকম চাকরী পেয়েছেন আরো ৫ জন বেকার যুবকও। তারাও এ উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
সম্প্রতি মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্তভাবে এ ৬ জনকে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব পদে মনোনীত করেন জেলা প্রশাসন।
যারা চাকরী পেয়েছেন তারা হলেন,গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের কাটরবাড়ি গ্রামের সজীব মন্ডল, কংশুর গ্রামের মামুন ফকির, মুকসুদপুর উপজেলার জলিরপাড় ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের কার্তিক মন্ডল, টেংরাখোলা গ্রামের মোঃ ইব্রাহীম, টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গুয়াধানা গ্রামের সুব্রত ভক্ত ও গোপালপুর গ্রামের লিপিকা ঘরামী।
গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নিয়োগ পরীক্ষায় কোন তদবির-সুপারিশ ছাড়াই শতভাগ স্বচ্ছতার মাধ্যমে মাত্র ৫ শ টাকার ব্যাংক ড্রাফট এ চাকরী পান তারা। সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর তাদেরকে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব পদে চাকরি চুড়ান্ত করেন জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম।
জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানাগেছে, গোপালগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার নাগরীকদের কাছ থেকে ৬টি ইউনিয়ন পরিষদ সচিব পদের বিপরীতে ৭শ ৮৩টি আবেদন পাওয়া যায়। আবেদন যাচাই বাছাইতে বিভিন্ন ভুলত্রুটির কারনে ২০টি আবেদন বাতিল হয়। মোট ৭শ ৬৩ জন বৈধ আবেদনকারীকে প্রথমে ৫০ নম্বরের প্রিলিমিনারি (এমসিকিউ) পরীক্ষা নেয়া হয়। এই পরীক্ষায় ১শ ৮৩ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়। পরবর্তিতে এই ১শ ৮৩ জনকে ৭০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় বসানো হয়। লিখিত পরীক্ষায় ৬টি পদের বিপরীতে ৪০জনকে রাখা হয়। সর্বশেষ ৩০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা শেষে চুড়ান্ত ফলাফলে এক নারীসহ ছয়জনকে চাকরীতে মনোনীত করা হয়।
চাকরিপ্রাপ্ত কার্তিক মন্ডল সাংবাদিককে বলেন, প্রথমে আমি মা-বাবাকে ধন্যবাদ জানাই সাহস যোগানোর জন্য। এরপর জেলা প্রশসক স্যারকে। কারন তিনি স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন বলেই আমি মাত্র ৫০০টাকায় চাকরীটা পেয়েছি। অনেক দপ্তরের চাকরী পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় এ কারণে আমরা যারা মেধাবী ছিলাম তারা তাদের কাছে টিকতে পারিনি। পরীক্ষা স্বচ্ছ হলে মেধাবীরা সব সময় ভালো করবে তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। চাকরী পেতে আমার বাড়তি কোন টাকা খরচ হয়নি। শুধুমাত্র ৫ শ টাকা ব্যাংক ড্রাফট জমা দিয়েছিলাম। আমি দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে চাই।
চাকরীপ্রাপ্ত মামুন ফকির বলেন, আমি একজন শারীরীক প্রতিবন্ধী । পায়ে সমস্যা হাটতে কষ্ট হয়। ক্রাসভর দিয়ে হাটতে হয়। একটি অফিসিয়াল জব খুবই দরকার ছিল। সেটা পেয়েও গেলাম স্বচ্ছ নিযোগ পরীক্ষার সুবাদে।আমি আমার মেধা,শ্রম আর সততা দিয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করবো। তিনি আরো বলেন সকল নিয়োগ পরীক্ষা যদি এভাবে স্বচ্ছ হয় তাহলে আমাদের দেশ সোনার দেশে পরিণত হবে।
চাকরীপ্রাপ্ত সুব্রত ভক্ত, মোঃ ইব্রাহিম খলীল ও সজীব মন্ডল বলেন, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এই ইউনিয়ন পরিষদ সচিব নিয়োগ পরীক্ষা শুধু জেলার মধ্যে নয় সারা দেশের মধ্যে স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। যে তিনটি ধাপে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে তা শুধু বিসিএস পরীক্ষায় হয়ে থাকে। কোন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয় বলে আমাদের জানা নেই। জেলা প্রশাসক স্যার যেহেতু স্বচ্ছতার মাধ্যমে আমাদের চাকরীতে সুযোগ সৃস্টি করেছেন আমরাও কর্মকান্ডের মাধ্যমে তার প্রতিফলন ঘটাবো। যাতে দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারে।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, ৭শ ৬৩ জনের মধ্যে থেকে ৬ জনকে বাছাই করা খুবই কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার। আমারা তাই প্রথমে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের যাচাই করেছি। পরবর্তীতে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে সেরা ৬জনকে বেছে নিতে পেরেছি। স্বচ্ছভাবে কাজ করতে আমার দপ্তরের কর্মকর্তাগণ বেশ আন্তরিক ছিলেন। তাই আমি মেধাবী ও যোগ্যদের বাছাই করতে সক্ষম হয়েছি। আশা করবো এ চাকুরীপ্রাপ্ত ৬জন তরুন তরুণী মেধা ও শ্রম দিয়ে দেশ ও সাধারন মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবেন।