শিরোনাম
॥ শাহাদুল ইসলাম সাজু ॥
জয়পুরহাট , ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ (বাসস): ২৬ এপ্রিল জয়পুরহাটের হৃদয় বিদারক ও লোমহর্ষক ‘কড়ই-কাদিরপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন (১৪ বৈশাখ, সোমবার ) জেলা শহর থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরত্বে সদর উপজেলার বম্বু ইউনিয়নের কড়ই ও কাদিরপুর গ্রাম দু’টিতে তৎকালিন স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকসেনারা মধ্যযুগীয় কায়দায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল ৩৭১ জন নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বী গ্রামবাসীকে। নিহতদের অধিকাংশই মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লুটপাট করা হয়েছিল তাদের টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ এবং দখল করা হয়েছিল তাদের জায়গা জমি ও বসত বাড়ি।
স্থানিয় ’সৃজনী’ নামে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বল্প সংখ্যক লোকজন নিয়ে প্রতি বছর ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোসহ স্বরণসভার আয়োজন করে থাকেন। এদিনের স্মৃতি ধারন করে এখানে এসে স্বজন হারানোরা চোখের জল ঝড়ালেও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা যেন শুধুমাত্র শহীদ পারিবারের সদস্যদেরই দায়। যেন কারও কিছু যায় আসেনা। এ ছাড়া বাবা-মা, ভাইসহ আত্মীয়স্বজন হারানো পরিবার গুলোর সদস্যরা বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে এসে ফুল দিয়ে, মোম জ্বালিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ২৬ এপ্রিল ( ১৪ বৈশাখ, সোমবার) জেলা শহর থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরত্বে সদর উপজেলার কড়ই ও কাদিরপুর গ্রাম দু’টিতে তৎকালীন স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মধ্যযুগীয় কায়দায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল ৩৭১ জন নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বী গ্রামবাসীকে। নিহতদের অধিকাংশই মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লুটপাট করা হয়েছিল তাদের টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ । দখল করা হয়েছিল তাদের জায়গা-জমি, বসত বাড়িও। এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবির প্রেক্ষিতে এ বধ্যভূমিতে স্থানীয় জেলা পরিষদের উদোগ্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এ নৃশংস ও বর্বর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত স্থানীয় দোসর দের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
শহীদ পরিবার গুলোর প্রত্যক্ষদর্শী স্বজনরা জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে কড়ই-কাদিরপুরের পাশে হানাইল, বম্বু গ্রামে মওলানা মোসলেম উদ্দিনের বাড়িতে একটি ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে যোগদেন কড়ই গ্রামের মওলানা জসিম উদ্দিন ও মওলানা আব্দুল মান্নান। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় কড়ই-কাদিপুর গ্রাম দু’টিতে পরের দিন ( ২৬ এপ্রিল) অপারেশন চালনো হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল সকালেই পাকিস্তানী হানাদাররা ামওলানা মোসলেম উদ্দিনের বাড়িতে নাস্তা করার সময় আশ-পাশের হানাইল-বম্বু, সগুনা, বামনপুর, হেলকুন্ডা, ছোট হেলকুন্ডা, মীরগ্রাম, মুরারীপুর, হিচমী গ্রামের লোকজন পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে কড়ই-কাদিরপুর গ্রাম দু’টি ঘেরাও করে। এ সময় পাকিস্তানী হানাদাররা ফাঁকা গুলি বর্ষণ করলে ভীত সন্ত্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ ভয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে। মওলানা জসিম উদ্দিন তখন তাদেরকে মারা হবেনা এ মর্মে আশ্বাস দিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লেøাগান দিতে দিতে মাঠের মধ্যে জড়ো হতে বলেন। এরপর ছয় পাকিস্তানী হানাদারর তিনভাগে ভাগ হয়ে লাইন করে গুলি চালায়। মাত্র এক থেকে দেড় ঘন্টার অপারেশনে ৩৭১ জনকে হত্যা করা হয় এখানে। এ ঘটনায় অনেকের মৃত্যু হলেও আধা মৃত অবস্থায় অনেকে বাঁচার জন্য আকুতি-মিনতি করতে থাকেন, কেউ পানি পানি করে চিৎকার করতে থাকেন। স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা এ সময় পানির বদলে প্রসাব খেতে দেয়। এতেই ক্ষান্ত না হয়ে মৃতদের সাথে আধা মৃতদেরও বিভিন্ন স্থানে করা গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়। কড়ই-কাদিরপুর গ্রামে ৩ শ ৬৬ মৃৎ শিল্পি পরিবারের সঙ্গে হিন্দু- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারও ছিল। এ নৃশংস গণহত্যার পরে দু/একটি পরিবার থাকলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর তারাও নানা হুমকি ধুমকিতে প্রাণ ভয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে পালিয়ে যান। তাদের প্রায় ৯ শ বিঘা জমি দখলে নেয় স্বাধীনতা বিরোধী স্থানীয়রা । বরাবরের মতো জয়পুরহাটের ‘কড়ই-কাদিরপুর গণহত্যা দিবস উপলক্ষে স্থানীয় শিক্ষা , সাংস্কৃতিক- সামাজিক সংগঠন ”সৃজনী’র উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে স্মরণসভা ও ‘কড়ই-কাদিরপুর বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হবে । সৃজনী’র প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান চেয়ারম্যান বিশিষ্ট্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ম, নূরুন্নবী স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করবেন বলে জানা গেছে। ওই হত্যাযজ্ঞে স্বজন হারানোদের দাবি জীবিত থাকতেই পিতা-মাতাসহ আত্মীয় স্বজনদের হত্যাকারী নরঘাতকদের বিচার দেখে যেতে পারলে আত্মা শান্তি পেতো। স্বামী সুবল চন্দ্রকে হারানোর বেদনা আজও বুকে লালন করছেন স্ত্রী সুধা রানী তিনি সেদিনের নৃশংসতার কথা বলতে গিয়ে আজও আঁৎতে ওঠেন। স্বজন হারানো লোকজন এখনো গনহত্যার স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারন করে বিচারের আশায় দিন গুনছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এ নৃশংস ও বর্বর গণহত্যার বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শহীদ পরিবারের স্বজনরা বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার হবে এমন প্রত্যাশা তাদের। উল্লেখ্য, সেই সময় স্থানীয় ভাবে গঠিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম ( পরে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে আমৃত্যু সাজা প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং বর্তমানে মৃত)। ১৯৭১ সালের জয়পুরহাটে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানী হারদারদের গণহত্যা চালানোর পেছন থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এ আব্দুল আলীম।