শিরোনাম
॥ নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল ॥
মুন্সীগঞ্জ, ২১ জুন, ২০২৪ (বাসস) : জেলার রজতরেখা নদীর উৎসমুখে আড়াআড়ি বাঁধ থাকায় বন্ধ রয়েছে নদীর প্রবাহ। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী নদীটি।
স্থানীয়রা জানায়, পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে রজতরেখা নদী। একসময় নদীটি ৪৮০ ফুটের মতো চওড়া ছিল। তবে বর্তমানে নদীটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীটি কোথাও ৩০ ফুট, ৪০ ফুট বা ৫০ ফুটের মতো চওড়া। ৮-১০ বছর ধরে নদীটির উৎমুখ বন্ধ করা হয়েছে। দীঘিরপাড় বাজারে একটি অংশ এখন এই রাজতরেখা নদীর উপর। সেখানে দোকানও নির্মাণ করা হয়েছে। এই দোকান পাটের দক্ষিণেই আড়াআড়িভাবে বাঁধ তৈরি করে চলাচললের রাস্তা করা হয়েছে। এই রাস্তা দিয়ে পাশের এক মাদ্রাসায় যাতায়াতের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৌশলে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার পর এখন দীঘিরপাড় বাজারের ময়লা-আর্বজনা ফেলা হচ্ছে রজতরেখার বুকে। পদ্মার সঙ্গে সংযুক্ত স্থল থেকে প্রায় ৪০০ মিটার উত্তর দিক পর্যন্তই রজতরেখার বেহাল চিত্র।
টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দীঘিরপাড় থেকে বেশনাল, পুরা বাজার, সদর উপজেলার শিলই, মাকহাটি, কাঁটাখালী হয়ে মুন্সীরহাট দিয়ে ধলেশ^রীতে যুক্ত হয়েছে প্রায় ১৮ কিলোমিটারের এই নদী। দুই দশক আগেও নদীটি প্রবহমান ছিল। নদীর পূর্ব পাশে মুন্সীগঞ্জ সদর ও পশ্চিম পাশে টঙ্গীবাড়ী উপজেলা।
বর্ষাকালে এই নদী কানায়-কানায় পূর্ণ থাকত। প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। এই নদী দিয়ে ছোট বড় লঞ্চই ছিলো জেলার দক্ষিণের সাথে যোগোযোগের পথ। এই পথে জেলার বাইরে শরিয়তপুরের পাট নারায়ণগঞ্জে যেতো এই পথে। মালবাহী নৌকা চলাচল করত প্রতিনিয়ত। তবে দখলের কারণে নদীটি এখন অস্তিত্ব হারিয়েছে। রজতরেখা আলদি এলাকায় কাজলরেখার সাথে যুক্ত হয়েছে। রজতরেখা এবং কাজলরেখা এই দুইনদীকে দুই বোন বলা হয়ে থাকে। আর তাদের জননী বলা হয় পদ্মা নদীকে।
মাকাহাটি থেকে পশ্চিমে আলদী বাজারের পাশ ঘেঁষে যে নদীটি পশ্চিমে টঙ্গীবাড়ির দিকে চলে গেছে এটিই হচ্ছে কাজলরেখা নদী। আর দীঘিরপাড় থেকে মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের এবং চর কেওয়ার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ছুঁয়ে কাটাখালী এবং মুন্সীরহাট দিয়ে মিলিত হয়েছে ধলেশ্বরী নদীতে,এটি রজতরেখা। রজতরেখা নদীটি স্বার্থলোভি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে ভরাট করে দখল করে নিয়েছে। ফলে নদীর জল প্রবাহবেগে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। জোয়ার-ভাটা বন্ধ থাকায় বৃষ্টির পানি জমে এখন পচে গেছে। দুগর্ন্ধ ছড়াচ্ছে।
পুরা বাজারের সামসুদ্দিন হালদার জানান, যে রজতরেখার টলমলে পানি দেখলে আকর্ষণ করতে, সেই পানি এখন কালচে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কৃষি কাজেও এই পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আলু উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ জেলায় এবার আলুর ফলন কম হয়েছে, এই নদীর পানি প্রবাহের খারাপ অবস্থার কারণে। মোল্লাকান্দির মহিউদ্দিন সুমন জানান, এই নদী মরতে থাকায়, বর্ষার পানি নামতে বিলম্ব হচ্ছে। তাই রোপণ বিলম্ব (লামি) হচ্ছে। অন্যান্য ফল আবাদেও সমস্যা হচ্ছে কৃষকের। এই নদীটি পুরো এলাকায় বর্ষার পলি আসতো, তাই জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু এখন যেন বোঝা হয়ে উঠেছে। এতে পরিবেশও বিপন্ন হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের (মুন্সীগঞ্জ-গজারিয়া) সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব বলেন, “রজতরেখা নদী এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণ। বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত, সেচ, উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত সর্বোপরি এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতির একটি চালিকা শক্তি। কিন্তু এই রজতরেখা মরে গেলে পার্থিব জীবন-যাত্রা ব্যাহতসহ যাবতীয় কর্মকা-ে বিরুপ প্রভাব পড়বে। আর নদী উদ্ধার করা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি এজেন্ডা। রজতরেখা নদী উদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা আমার জোর দাবি।
মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের (মুন্সীগঞ্জ-গজারিয়া) সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, রজতরেখা এই অঞ্চলের আর্শিবাদ। নৌ-যোগাযোগ ছাড়াও এই নদী জীববৈচিত্র্য রক্ষা ছাড়াও বহুমুখী সুফল দিচ্ছে। এই নদী টঙ্গীবাড়ি এবং মুন্সীগঞ্জের কয়েক লাখ মানুষের জীনযাত্রার সাথে প্রত্যক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। প্রাচীন নদীর উৎসমুখ খুলে দেয়া ছাড়াও পুরো নদীটি উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। তাই দখলদারদের সঠিক তালিকা করে দখলমুক্ত করা এবং নদীটি দ্রুত খনন করে পানি প্রবাহ চালুর দাবি জানান তিনি।
পরিবেশ বিজ্ঞানী আরিফুর রহমান জানান, মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী থেকে রজতরেখা প্রবাহিত হয়ে দীঘিরপাড়ে পদ্মা নদীতে পতিত হয়েছে। আলদী বাজারে কাজলরেখার সাথে মিলিত হয়েছে রজতরেখা। তবে কাজলরেখার পানি প্রবাহ রজতরেখার উপর নির্ভরশীল। দীঘিরপাড়, যশলং, আলদী আর সদর উপজেলার কেওয়ার, মাকহাটি ও মোল্লাকান্দিসহ আশপাশের বহু মানুষের গ্রামীণ জীবন ও জীবিকা ছিল রজতরেখা নদীকে কেন্দ্র করে। কৃষি, বাণিজ্য, রাজনীতি সবই নিয়ন্ত্রিত হয় এই নদীকে কেন্দ্র করে। মুন্সীগঞ্জের কাটাখালি পরে দক্ষিণে আলদী পর্যন্ত কিছুটা পানি প্রবাহ থাকলেও আলদী থেকে দীঘিরপাড় পর্যন্ত পানি প্রবাহ একবারেই ক্ষীণ।
মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ আন্দেলন (বাপা) সভাপতি অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান বলেন, নদীর দুইপাড় দখল করে বাড়ি নির্মাণ করার ফলে নদী সরু হয়ে গেছে। দীঘিরপাড়ে যেখানে পদ্মায় মিলিত হয়েছে সেখানেই মূল বাঁধা। পদ্মার সাথে রজতরেখাকে বিচ্ছন্ন করা হয়েছে বাঁধ দিয়ে আর ময়লা আবর্জনা ফেলে। দীঘিরপাড় বাজারের পূর্বাংশই এখন এই রজতরেখা নদীর উপর। পদ্মার সাথে সংযোগস্থলটি দখল করে এই বাজার স্থাপন করায় রজতরেখা দ্রুত মরে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পদ্মার সাথে যুক্ত শাখা নদী এবং খালগুলো ভরাট হওয়ার লোকালয়ে পানি প্রবেশ বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় নদী ভাঙ্গনসহ পানি নামতে না পারায় পলি জমে স¤পর্ণ নদীটি ভরাট হয়ে গেছে কৃষির স্বার্থে নদীকে আগের রূপে ফিরিয়ে নেওয়া সময়ের দাবি নদী খনন আবার ফিরিয়ে দিতে পারে এই এলাকার প্রাণ-বৈচিত্র্য। এক সময় মুন্সীগঞ্জের কাটাখালি থেকে দিঘীরপাড় পর্যন্ত সারাবছর ছোট লঞ্চ চলাচল করতো। কাটাখালি থেকে এই লঞ্চ রুট ছিল মাকাহাটি-পুরা বাজার-বেশনাল-হালদার বাড়ি- দীঘিরপাড়।
বাপা সভাপতি জানান, এখন সেটা বন্ধ, নৌ-পথটি সচল হলে আবারো কৃষি বাণিজ্য থেকে শুরু করে গ্রামীণ অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হতো নদীটিকে কেন্দ্র করে।
জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপন বলেন, সমস্যাটি কয়েক বছর আগে থেকেই। খোঁজ-খবর নিয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। দখলমুক্ত করতে উদ্ধার অভিযানসহ কিভাবে নদীটির জীবন ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।