বাসস
  ২৬ জুলাই ২০২৪, ২০:২১

মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে আঘাতের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন আমরা একাত্তর নেতৃবৃন্দ

ঢাকা, ২৬ জুলাই, ২০২৪ (বাসস) : মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে আঘাত করে এমন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আমরা একাত্তর নেতৃবৃন্দ। 
গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপি কোটা সংস্কার আন্দোলনে নানাভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মানজনক শ্লোগান ও উক্তির প্রতিক্রিয়ায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর প্রতি এক খোলা চিঠিতে তারা আজ এ আহ্বান জানান। 
উচ্চ আদালতের এক রায়ের প্রেক্ষিতে  “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” নামে গত ১ জুলাই থেকে ছাত্ররা সরকারি চাকুরীতে দেশে প্রচলিত কোটার হার সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলন প্রথম দিকে সুশৃংখল থাকলেও তা ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হতে থাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা ও কটুক্তি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান করে শ্লোগান দেয়া হয় যা শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের মর্মাহত করে। যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশই কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষে ছিলেন। 
মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ প্রজন্মের সংগঠন আমরা একাত্তরের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান এবং সাধারণ সম্পাদক হিলাল ফয়েজী’র স্বাক্ষরিত এই খোলা চিঠিতে তারা বলেন, “আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবি নিয়ে তোমরা ছাত্রসমাজ পয়লা জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করেছিলে। এই আন্দোলনের প্রতি সাধারণ ছাত্র, অভিভাবকসহ সকলের সমর্থন ছিল। বিশ দিনের মাথায় তোমরা তোমাদের দাবি আদায়েও সফল হয়েছ।”
১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমশ: সহিংস হয়ে পরে। ছাত্ররা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য সরকারি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী শ্লোগান দেয়। যা জাতিকে গভীর এক ষড়যন্ত্রেরই যেন আভাস দিলো।   
আমরা একাত্তরের খোলা চিঠিতে বলা হয়, “এক অর্থে এটি ছিল এক অনন্য আন্দোলন,  যেখানে সরকারসহ প্রকৃত অর্থে কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। অথচ এমন একটি আন্দোলন এক পর্যায়ে চরম সহিংসতায় রূপ নিলো; নির্মমভাবে ঝরে গেলো অনেক তাজা প্রাণ। ঘটনা প্রবাহ এখানেই শেষ হলো না। এক পর্যায়ে আন্দোলনে যুক্ত হলো কোটা সংস্কারের সাথে সম্পর্কহীন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে চরম অশ্লিলতাপূর্ণ; উচ্চারণ-অযোগ্য সব স্লোগান। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল সুর যেন ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠলো মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার আন্দোলন।  তার সমান্তরালে চললো বেছে বেছে মূল্যবান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায়  ভয়ানক দানবীয় ধ্বংসযজ্ঞ। আমরা যারা একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলাম, যারা এখনো মুক্তিযুদ্ধকে জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে গণ্য করি -- অনুভব করলাম আমাদের হৃদয়ের  রক্তক্ষরণ।  
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে তারা বলেন, তোমাদের মনে যত অভিমান, ক্ষোভ-সংক্ষোভ, রাগ-অনুযোগ থাকুক না  কেন, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশের বুক থেকে "আমরা সবাই রাজাকার" স্লোগান উচ্চারিত হবে এমনটি দুঃস্বপ্নেও কোনো মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের জনগণ ভাবতে পারে না। আমাদের হৃদয়ের  রক্তক্ষরণ এ কারণেই।
চিঠিতে ছাত্রদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘রাজাকার’ শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি এর সঠিক অর্থ জেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়,  মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার মানে ছিল নির্মম হত্যাকারী নরপশু, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর  জেনোসাইডের সক্রিয় সহযোগী; রাজাকার অর্থ ছিল আমাদের মা- বোনের ধর্ষক; রাজাকার মানে স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার তাবেদার সৈনিক।
খোলা চিঠির উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে এতে আরো বলা হয়, “তোমাদের ন্যায্য দাবি পূরণ সাপেক্ষে দেশে যখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে, যখন তোমরা নির্মোহভাবে ফিরে তাকাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের গতি প্রকৃতির দিকে, তোমরা স্পষ্টই দেখতে পাবে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামাত-শিবির পরিকল্পিতভাবে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করে দেশকে ভয়ানক নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। দাবি আদায়ের আন্দোলন, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন আর সুকৌশলে আন্দোলনের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক তৎপরতা কখনোই সমার্থক হতে পারে না। 
আমরা একাত্তর নেতৃবৃন্দ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার অপচেষ্টার নিন্দা জানিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে এ ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট অবস্থান দেশ ও জনগণের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি  মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে আঘাত করে এমন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। 
তারা কোটা  সংস্কার আন্দোলনে মর্মান্তিকভাবে নিহতদের প্রতি গভীর শোক এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সকল মৃত্যুর সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।