বাসস
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:৪৯

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন দাবি

ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস):  জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা  ও পুনর্বাসন এবং শহিদ ও আহতদের  দ্রুত প্রকৃত তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে ‘লড়াকু ২৪’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী  সংগঠন।
একই সাথে তারা এসব বিষয়ে জরুরি তথ্য সংগ্রহ কমিটি গঠন, চিকিৎসা পরিস্থিতি নিয়ে সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিং, চিকিৎসকদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠনের দাবিসহ মোট ১৫টি দাবি উত্থাপন করেন। 
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থী-জনতার যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলন এসব দাবি জানায় ‘লড়াকু ২৪’ নামে সংগঠনটি।  সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসার ভয়াবহ পরিস্থিতি উঠে এসেছে। আহতদের স্বজনরা তাদের বক্তব্যে দুর্ভোগ, কষ্টের চিত্র তুলে ধরেছেন।
আহতদের মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ মিজানুর রহমান জানান, ছড়ড়া গুলির আঘাতে তার দুটি চোখ ক্ষতিগ্রস্ত। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অবহেলা, খারাপ আচরণসহ অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে তাকে। অপারেশনের পর এক চোখে এখন কিছুটা ঝাপসা দেখতে পান। চোখে এখনও ব্যথা আছে এবং পুরোপুরি সেরে উঠবেন কি না এনিয়ে নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা। দুই সন্তানের বাবা মিজানুর রহমান কীভাবে তার সন্তানদের বড় করবেন তা তিনি এখন জানেন না।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আহত মুরাদ ইসলামের স্ত্রী রাণী ইসলাম।  মুরাদ ইসলামের  গুলিবিদ্ধ হওয়ার দিনের ঘটনা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। শহিদ সোহরাওয়ার্দী, আল-হেলাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ রাতভর একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করানো সম্ভব হয়। রাণী ইসলাম বলেন, কোনো হাসপাতালে ভর্তি না নেয়ায় অস্ত্রোপচারে দেরি হয়ে যায়। এরপরেও হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাওয়া যায়নি। মুরাদ ইসলাম এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তিনি বাঁচবেন কি না চিকিৎসকরা এই নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। তার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য রাষ্ট্র, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এই ভুক্তভোগী পরিবার।
আহত রিকশাচালক আব্দুল্লাহর স্বজন আইয়ুব আলীও হাসপাতালের সেই কঠিন দিনগুলো স্মরণ করেছেন। আইয়ুব আলী বলেন, ‘ডাক্তারদের না দেখে আমি আহত অবস্থায় আসতে থাকা একের পর একজনকে নিজের হাতে ড্রেসিং করছি। মনে হইছিলো হাসপাতাল যেন থরথর করে কাঁপছে। আমার মনে হয় আমি এখনো তাদের মাগো, বাবাগো চিৎকার শুনি।’
আহত স্বজন নিয়ে হাসপাতালের প্রায় ১ মাস ১০ দিনের সে সময়কার কথা স্মরণ করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা থাকাকালীন একেক জন ডাক্তার ও নার্সদের আচরণ দেখে মনে হয় নাই এটা স্বাধীন দেশ।’
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন ‘লড়াকু ২৪’ প্ল্যাটফর্মের সুমিতা রবিদাস।  মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন কানিজ ফাতেমা মিথিলা। 
মিথিলা তার বক্তব্যে বলেন, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতেতে গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ আহত শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে মোট ৪জন নারী স্বেচ্ছাসেবকের উদ্যোগে বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে ৪টি হাসপাতাল সরেজমিনে পরিদর্শন কেরন তিনি। এই ৪টি হাসপাতাল হলো- শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এন্ড হসপিটাল এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ট্রমাটোলোজি এন্ড অর্থপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটোর) পঙ্গু হাসপাতাল ।
তারা গুলিবিদ্ধ রোগীদের হাসপাতাল কর্তৃক সেবা প্রদান পরিস্থিতি, রোগীদের আর্থ-সামাজিক সংকট এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার ভয়াবহ ও অমানবিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৪টি হাসপাতাল স্বশরীরে পরিদর্শন করে ৯৭ জন আহতের তালিকা প্রস্তুত করি যেখানে এ পর্যন্ত ৩৩ জন শিক্ষার্থী, ৬৪ জন শ্রমজীবী রয়েছেন। এটি এই উদ্যোগের প্রাথমিক তালিকা। তালিকায় রোগীর নাম, বয়স, পেশা, আহতের বিবরণ, তারিখ, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, মাসিক উপার্জন, পরিবারে উপার্জনকারীর সংখ্যা ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই আহতদের মধ্যে ৫৫ জন তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখনও এসকল তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’
ইংরেজী দৈনিক নিউ এইজ পত্রিকার সাংবাদিক ড. সায়দিয়া গুলরুখ বলেন, ‘আজকে আমরা যখন কথা বলছি, তখনও হাসপাতালে যেসকল শিক্ষার্থী-জনতা আমাদের বিজয় এনে দিয়েছেন তারা আজরাইলের সাথে, যমের সাথে জান নিয়ে লড়াই করছেন। তাই বলতে চাই, বিগত সময়ের মতো আমরা সরকারের কাছ থেকে আর আশ্বাসের বাণী শোনা বা কালক্ষেপণের সেই আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দেখতে চাই না।’
আরেক বক্তা নৃবিজ্ঞানী ও লেখক রেহনুমা আহমেদ বলেন, ‘যেহেতু যুদ্ধ কথাটা উচ্চারিত হয়েছে তাই বলতে চাই এদেশে কিন্তু ২০২৪ এ যুদ্ধ ঘটেছে। একটি সরকার তার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখন আমরা যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় আছি। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সাধ্য মতো শহিদ ও আহতদের বিষয়ে নিশ্চয়ই কাজ করছেন। কিন্তু এটা যদি আমরা বুঝতে পারি যে এখন যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা তাহলে কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে পরিস্থিতি শামলাতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার যে সকল প্রটোকল আছে তা কাজে লাগানো যেতে পারে এবং সমন্বিত কাজ করতে হবে । তা না হলে এটা হবে জাতীয় লজ্জার! এই লজ্জা শুধু অন্তর্বর্তী সরকার নয়, সকলের ওপর বর্তাবে। আমরা কী অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া একেকটি পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারি না? তা সচেতন নাগরিকদের ভাবতে হবে।’ 
যে সাহস ও শক্তি নিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছে সেই চেতনা ধরে রাখারও তাগিদ দেন রেহনুমা আহমেদ।