বাসস
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৯

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধনে খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন

ঢাকা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বাসস): আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ যুগোপযোগী করতে আইনটির ৮টি ধারায় সংশোধনে খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিদ্যমান এ আইনটিকে আরো যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞগণ।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে এ খসড়া উপস্থাপন করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩’ সংশোধন বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় খসড়া সংশোধনী প্রস্তাবগুলো সোমবার তুলে ধরা হয়।
রাজধানীতে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.  আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয়া সংগঠকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিগণ অংশ নেন। 
সংশোধনের খসড়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যুক্ত করা এবং কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিসহ আইনে পাঁচটি ধারা-উপধারা সংযোজন এবং তিনটি ধারা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
সভার সভাপতির বক্তৃতায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, যেসব নেতা বা যেসব ব্যক্তি এখানে (ট্রাইব্যুনালে) বিচারের সম্মুখীন হবে, তাদের যারা সমর্থক আছেন, তাদেরও যেন মনে হয় সত্যি উনি (যিনি বিচারের সম্মুখীন হবেন) অন্যায় করেছেন বা অন্যায় করেননি, তারাও যেন সন্তুষ্ট থাকেন। আমরা এই সমাজে আর ক্ষত চাই না। বিভাজন চাই না। বিচারের মধ্য দিয়ে একটা পুনর্মিলন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই।  
মতবিনিময় সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, কনসালটেশনের (আলোচনা) মাধ্যমে আরও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সামনে আসবে। যে খসড়া হয়েছে, সেটি চূড়ান্ত নয়। আরও আলাপ-আলোচনা চলবে। তারপর আইনটাকে পরিপূর্ণ করা হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয় এবং  গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে আইনটি সমৃদ্ধ হবে। সব দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সম্মিলিতভাবে হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো (জুলাই-আগস্টের হত্যাকা-) চায়, বিচার যেন নিশ্চিত হয়।
সভায় স্বাগত বক্তৃতা করেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান বৈশ্বিক পটভূমিতে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বিচারব্যবস্থার মানদ-ের আলোকে আইনটি সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আইনের খসড়া প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আশফাকুর রহমান। এতে বলা হয়, এই সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোর করে যৌনকর্ম, জোর করে গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আগের আইনে ছিল না। এ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে আরও বলা হয়, বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন। অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন বলে খসড়া প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
সভায় এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গুড ইনটেনশন নিয়ে সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে।  সংশোধনীর যে প্রস্তাবগুলো আনা হয়েছে, আসামিদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি খসড়ায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ভিকটিমের পরিবারের আইনজীবী রাখার বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। 
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে এই আইন এমনভাবে সংশোধন করা হোক, যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী এবং আসামি-দুই পক্ষই যাতে মনে করে ন্যায়বিচার হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আন্দোলনের বার্তা দুটি, তা হলো অন্যায় যারা করেছে তাদের বিচার হওয়া ও রাষ্ট্র মেরামত করা। 
তিনি বলেন, চার ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। একটা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। আরেকটি হলো ফৌজদারি অপরাধ। যারা গুম করেছে, খুন করেছে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। তৃতীয় হলো আর্থিক দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংক লুট ও বিদেশে টাকা পাচার। আরেকটি হলো নির্বাচনব্যবস্থা-সংক্রান্ত অপরাধ। যারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের অপরাধের বিচার। 
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার সারা হোসেন বলেন, ভিকটিমই শুধু নয় অভিযুক্তরাও যেন ন্যায়বিচার পায় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সকলকে তাই আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার কথা ভাবতে হবে। কোনরূপ সেন্টিমেন্টকে আমলে না নিয়ে আইন অনুযায়ী স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।  
প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ  নামে ৩টি  নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও  ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়।
প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে সভায় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ মতামত ব্যক্ত করেন।  তারা বলেন, বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখবো ভাবি নাই যেখানে হেলিকপ্টার দিয়ে আন্দোলনরত মানুষকে নির্মূলে গুলি করা হয়। অপরাধে যারা জড়িত স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। 
বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ ফ্যাসিবাদের বিলোপ, সংস্কার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। ৮টি ধারায় সংশোধনীর খসড়ায় কিছু বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ আরো যুগোপযোগী করতে সংশোধনে ট্রাইব্যুনালে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। 
আলোচনা ও মতবিনিময়ে আরো অংশ নেন তারা হলেন সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না,  সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া,  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের  অধ্যাপক ড. বেগম আসমা সিদ্দীকা, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ডা. জাহেদুর রহমান, সানজিদা ইসলাম, শরিফ ভূঁইয়াসহ প্রমুখ । এ সময় আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।