বাসস
  ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:১৮
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:২৭

মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের পর থেকে কুমিল্লা অঞ্চলে খাদির প্রসার ঘটে

॥ মহসীন কবির ॥

কুমিল্লা, ২০ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস): জেলার খাদির সুনাম দেশজুড়ে। ১৯২১ সালে মহাতœ্যা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের  পর থেকে কুমিল্লা অঞ্চেলে খাদির প্রসার ঘটে।অন্যান্য জেলার কেউ এখানে বেড়াতে আসলে খাদির দোকানে উঁকি না মেরে পারেন না।  ঐতিহ্য আর নান্দনিক ডিজাইনের বাহারি শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, থ্রি-পিস এর প্রতি ক্রেতাদের বাড়তি আকর্ষণ সব সময়ই দেখা যায়। এমনটি ভাষ্য বিক্রেতাদের। শুধু তাই নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রয়েছে এর চাহিদা। তবে খাদি কিনতে এসে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। কারণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশসহ শহরের ভেতরে নামে-বেনামে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য খাদির দোকান। এর অনেকগুলোতে নকলের ছড়াছড়ি রয়েছে বলে খোদ একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ। তাদের দাবি খাদির নামে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

নামকরণ যেভাবে:
খাদ থেকে তৈরি হয় বলেই এর নামকরণ করা হয় খাদি। তবে এ নিয়েও নানা মতামত রয়েছে। প্রথমদিকে খাদি চরকায় সুতা কেটে তৈরি করা হতো বলে এর জন্য খাদের প্রয়োজন ছিলো না। তবে একটা সময় কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মাটিতে গর্ত করে খাদ বানিয়ে তাতে পায়ে চালিত প্যাডেল দিয়ে খাদি কাপড় তৈরি করা হতো, যেন দ্রুত কাপড় উৎপাদন করা যায়। সেই থেকে খাদি নামটির উৎপত্তি বলে কেউ কেউ মনে করেন। মনোহরপুরের খাদি ভবনের সত্বাধিকারী কানাই দাস গুপ্ত জানান, খাদে বসে হ্যান্ডলুমে তাঁত বোনা হয় বলে এ কাপড়ের নামকরণ করা হয়েছে খাদি। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু ১৯৫৫ সালে। বর্তমানে লাকসাম রোডের রামঘাটলায় একই প্রতিষ্ঠানের আরও একটি শো-রুম রয়েছে। এক সময় দুর্গাপূজার দশমীর দিন কুমিল্লায় খাদি কাপড় বিক্রির ধুম পরতো। তবে সময়ের ব্যবধানে ঈদ ও পয়লা বৈশাখসহ সব ধরনের উৎসবেই খাদির চাহিদা থাকে।

কুমিল্লায় খাদির যাত্রা:
কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক মীর আহসানুল কবির বলেন, খাদির গোড়াপত্তন হয় এক শতাব্দী আগে। ১৯২১ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় সর্ব প্রথম মহাত্মা গান্ধী বিদেশি পণ্য বয়কটের ডাক দেন। মোটা কাপড়, মোটা ভাত-সর্বত্র এমন স্লোগান ওঠে। এ আন্দোলনের পর খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। গান্ধী নিজেও খাদির চাদর ব্যবহার করতেন। তার দেখাদেখি কুমিল্লাসহ এতদঞ্চলের মানুষ খাদি কাপড়ে আকৃষ্ট হন। তখনকার রাজনৈতিক নেতারা খাদির পায়জামা, চাদর, পাঞ্জাবি পরতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। তিন দশক আগে থেকেই এর প্রচলন ছিলো ব্যাপকহারে। যার ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত আছে। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে শৈলেন্দ্রনাথ গুহ নামের এক ব্যবসায়ী জেলার দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতায় গ্রামীণ খাদি নামে প্রথম খাদির কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুমিল্লা থেকে খাদি শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হয়। এতে এ শিল্পে কিছুটা স্থবিরতা নেমে আসে। ১৯৫২ সালে ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লায় ‘দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। শৈলেন্দ্রনাথ গুহ বরকামতার খাদির কারখানাটি ধরে রাখেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে বিজন গুহ এর হাল ধরেন। সেখানে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত একটি তাঁতশিল্প এখনও বিদ্যমান। গুনগত মানের জন্য ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় কুমিল্লার খাদিশিল্প।

খাদির দোকানগুলোর অবস্থান:
কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর, কান্দিরপাড় ও লাকসাম রোডের রামঘাটলা এলাকায় রয়েছে খাদিঘর, খাদি ভবন, খাদি বিতান,খাদি ভূষণ, পদ্মা খাদিঘর, আদিকালের খাদি, শুদ্ধ খদ্দর ভাণ্ডার, গ্রামীণ খাদি ভাণ্ডার, খাদি কুটির শিল্প,বিশুদ্ধ খদ্দর ভাণ্ডার, সৌরভ খাদি ভাণ্ডার, প্রসিদ্ধ খাদিঘর ও রাম নারায়ণ খাদি স্টোরসহ বিভিন্ন নামের চার শতাধিক শো-রুম। এর বাইরেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন বিভিন্ন অভিযাত রেস্টুরেন্টের সামনেও খাদির দোকান রয়েছে। মনোহরপুরের সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠান খাদিঘরের সত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা ক্রান্তি জানান, তার প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু ১৯৪৮ সালে। এটি প্রতিষ্ঠা করেন তাদের পূর্ব পূরুষ তরুণী মোহন রাহা। বংশ পরম্পরায় তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে তিনিও পারিবারিক ব্যবসার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

খাদির ধরণ:
খাদি মূলত প্রাকৃতিক আঁশ থেকে তৈরি একটি তন্তু। প্রথমদিকে খাদি কাপড় ছিলো মূলত সুতি। তবে দুই ধরনের সুতি সুতার উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি খাদি যাকে বলা হয় সুতি খাদি এবং সিল্কের উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি খাদিকে বলা হয় এন্ডি সিল্ক বা খাদি সিল্ক। এমনটিই জানান কারিগরেরা।

দাম নিয়ে ক্রেতাদের মন্তব্য
মনোহরপুরের মনোমিল টাওয়ার, হিলটন টাওয়ার ও ভূঁইয়া ম্যানশনসহ একাধিক দোকান ঘুরে দেখা গেছে অনেক বিক্রেতাই একইদামে পোশাক বিক্রি করছেন। এক্ষেত্রে খুব একটা তারতম্য নেই। পাঞ্জাবি ৪০০-১২০০, শার্ট ৩৫০-৭৫০, থ্রি-পিস ৫০০-১৫০০ ও শাড়ি বিক্রয় হচ্ছে ৭৫০- ১৬০০ টাকার মধ্যে। খাদি ভবনের বিক্রেতা বাবুল পাল বলেন, খাদির পোশাক সব সময় একই দামে বিক্রয় হয়ে থাকে। কোনো বিশেষ উৎসবের সময় দাম বাড়ানো হয় না। বরং গুণগত মান ঠিক রেখে নতুন নতুন ডিজাইনের সমাহার থাকে। ক্রেতা কলেজ শিক্ষক খন্দকার বোরহান উদ্দিন বলেন, খাদির পাঞ্জাবি ও ফতুয়াতে এক ধরনের আরামবোধ করি। তাই নিজেও সব সময় খাদির পোশাক পরি। একই কথা বললেন, নারী ক্রেতা তাওহীদা লিজা। তিনি জানান, খাদির ব্যতিক্রমী ডিজাইনের থ্রি-পিস ও শাড়ির প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। তাছাড়াও খাদিতে স্বস্থি ও আরামবোধ রয়েছে। দামও তুলনামূলক সাশ্রয়ী। তাই আমার প্রথম পছন্দ খাদি।

বিদেশেও সরবরাহ হচ্ছে
শুধু দেশেই নয়, কুমিল্লার খাদির সুনাম বিশ্বজুড়ে। বিশেষ করে ভারত, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশেই এর রফতানি হয়ে থাকে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এরপরও সংকট কাটছে না শঙ্কা
দিন দিন খাদির জনপ্রিয়তা বাড়লেও অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে কী না, এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাধিক কারখানা মালিক। কারণ সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত তুলার অভাব। মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে হস্তচালিত তাঁত দ্বারা উৎপাদনে হিসেব মেলানো কঠিন। উৎপাদন খরচের তুলনায় বিক্রয় মূল্য অপ্রতুল। তাই এক্ষেত্রে নতুন উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছেন না। বরং চান্দিনা, দেবীদ্বার ও মুরাদনগর এলাকার অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চান্দিনার বেলাশ্বর এলাকার কারখানার মালিক বিপ্রদাস রায় বলেন, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন উপাদানের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে সে অনুযায়ী উৎপাদিত কাপড়ের দাম নেয়া যাচ্ছে না। অনেক সময় কারিগরদের বেতনও সঠিক সময়ে দেয়া সম্ভব হয় না।

খাদির নামে বিড়ম্বনা:
মনোহরপুর এলাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানান, খাদির নামে জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যঙের ছাতার মতো দোকান গজিয়েছে। যেখানে আমরা সরাসরি কারখানা থেকে উৎপাদন করি, সেখানে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ঢাকা ও নরসিংদী থেকে বাটিকের কাপড় এনে খাদি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। শুদ্ধ খাদি ভা-ারের পরিচালক শ্যামল রায় বলেন, আসল খাদি বোনা হয় তাঁতে। আর নকলগুলো মেশিনে বানিয়ে চকচকে রূপ দিয়ে বাজারজাত করা হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা, আর প্রতারিত হন ভোক্তারা।

বিশিষ্টজনদের প্রস্তাবনা:
 সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লা জেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শ্হা মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, খাদি শিল্প কুমিল্লাবাসীর গৌরবময় ঐতিহ্য। তাই এর ব্যাপক প্রসারে আরও পৃষ্ঠপোষকতা করা যায় কিনা, সে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে নীতি-নির্ধারকদের। বেসরকারি সংস্থা এইড কুমিল্লার পরিচালক রোকেয়া বেগম শেফালী বলেন, খাদি শিল্প আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণ করে। তাই এর সমৃদ্ধিতে পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়ছার বলেন, খাদি কুমিল্লার একটি ব্র্যান্ড। তাই এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এর ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে তিনি আহ্বান জানান।