শিরোনাম
॥ ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ॥
নাটোর, ২৯ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : বৈচিত্র্যময় দেশের বৃহত্তম চলনবিল ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দখল আর দুষণসহ অপরিকল্পিত কার্যক্রমের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে বিলের জীববৈচিত্র্য। গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহন এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমে চলনবিলকে রক্ষা করতে হবে।
উজান থেকে পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হয় বলে এই বিলের নাম চলনবিল। অন্য বিলে পানি বদ্ধ থাকলেও চলনবিলের পানি থাকে চলমান। বর্ষা মৌসুমে তীব্র স্রোতধারা অনেক সময় ভয়ংকর রুপ ধারণ করে। প্রতিবছর দেশের হাজারো দর্শনার্থী বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে নৌকা ভ্রমনে এসে মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে যান।
নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলার ১২টি উপজেলায় বিস্তৃত দেশের সর্ববৃহত্তম চলনবিলের আয়তন ছিলো এক হাজার বর্গ কিলোমিটারের অধিক। সংকুচিত হয়ে বর্তমানে বিলের আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩৬০ বর্গ কিলোমিটারে। বড়াল এবং আত্রাইসহ চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ৪০টি নদী, ৫০টি বড় খাল, ৩০০টি ছোট খাল, ২০ হাজার সরকারি পুকুর আর ৭০ হাজার ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর। এসব জলাধারের প্রবাহ চলনবিলে প্রাণ সঞ্চার করে। তবে পদ্মা, যমুনার পানির সংকট চলনবিলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ব্যাপকভাবে। বিশেষ করে পদ্মা নদীর চারঘাট রেগুলেটর বড়াই নদীর প্রবাহ তথা চলনবিলে পানি সংকট তৈরী করেছে।
চলনবিলের বুক চিরে হাজারো সড়ক ছাড়াও বিভিন্ন জলাধারের উপরে অপরিকল্পিতভাবে ৫০টি স্লুইস গেট, আড়াই হাজার কালভার্ট, ১৫০টি ছোট ব্রীজ এবং একটি রাবার ড্যাম পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করেছে। এই সংকটকে আরো গভীর করেছে সাড়ে ছয় হাজার গভীর নলকূপ, লক্ষাধিক অগভীর নলকূপ এবং সাত থেকে আট হাজার সাবমার্সিবল পাম্প।
উপরে পানির প্রবাহ নেই, নীচে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে অনেক নীচে। এ যেন মরার উপরে খাঁড়ার ঘা! আবার বাণিজ্যিকভাবে আপাত লাভজনক বিবেচনা করে ফসলী জমিতে পুকুর খনন করে সৃষ্টি করা হচ্ছে জলাবদ্ধতা। দখল হয়ে যাওয়া জলাধার আর নদীতে অবৈধ ¯্রােতি জালের অবকাঠামো স্থাপন করেও পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুরো বিল জুড়ে প্রতিদিন শ্যালোমেশিন চালিত নৌকা যাতায়াত করে শুধু পানিকেই দুষিত করছে না, তৈরী হচ্ছে শব্দ দুষণ।
আবাদী জমি আর পুকুর-দিঘীতে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়সিক সার আর কীটনাশক। এরসাথে হাজারো চালকল, শিল্প, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী খামারের বর্জ্য দুষিত করছে চলনবিলকে। ফসলী জমিতে ইরির স্কীম করার ফলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সিংড়া উপজেলার শেরকোলে চলনবিল ভরাট করে টিটিসি, সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবিশন সেন্টারসহ পাঁচটি অবকাঠামো এবং বিপরীতে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হচ্ছে। নাটোর বিসিকের সম্প্রসারিত শিল্পাঞ্চল চলনবিলে স্থাপনের প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছে!
এক সময় ১৫০ প্রজাতির দেশীয় মাছের ভান্ডার ছিলো চলনবিল। এই বিলের কৈ, শিং. বাছা, পাবদা, আইড়, গুচি-বাইম মাছের খ্যাতি তো দেশজুড়ে। বিলুপ্ত প্রায় শিলন মাছের দেখা পাওয়া যায় চলনবিলে। দেশী-বিদেশী হাজারো পাখির কলতানে মুখর থাকতো চলনবিল। চলনবিলের বিস্তৃত জলাভূমিতে কাঁকড়া, শামুক আর ঝিনুকও প্রসিদ্ধ। হিজল আর জারুল ফুলের সুবাস চলনবিলকে সুশোভিত-সুরভিত করে রাখতো। চলনবিলের এসব ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
তবে আশার কথা, চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে কাজ শুরু হয়েছে। জনসচেতনতার মাধ্যমে তৈরী হচ্ছে জনমত। চলনবিলের পাখি, শামুক, ঝিনুক রক্ষায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জানান, শিকারীদের হাত থেকে চলনবিলের পাখিদের বাঁচাতে আমরা একযুগ ধরে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি। এসব অভিযানে উদ্ধারকৃত পাখি, সাপ. কচ্ছপ অবমুক্ত করা হচ্ছে, অভিযুক্তদের দ- প্রদান করা হচ্ছে। জব্দ ও ধ্বংস করা হয়েছে এয়ারগান। উপজেলা প্রশাসন সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার হা-মীম তাবাসসুম প্রভা বলেন, চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন সব সময় তৎপর রয়েছে।
বিএডিসি (সেচ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, ইরি মৌসুমে চলনবিলে গভীর ও অগভীর নলকূপে নিরবচ্ছিন্ন পানি উত্তোলন করা হয়। মার্চ-এপ্রিল মাসে অনেক জায়গাতে পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপ তখন আর কাজ করে না। তবে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিএডিসি ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ভূউপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নাটোর জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, চলনবিলে আধুনিক কৃষি চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলনের মাধ্যমে কৃষকদের সমৃদ্ধি এসেছে, তবে অধিক ফসল উৎপাদন করতে যেয়ে জীববৈচিত্র্য যেন ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপব্যবহার রোধকল্পে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমরা সক্রিয়। মৎস্য বিভাগ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে জীববৈচিত্র্যের জন্যে হুমকিস্বরুপ স্রােতি জাল, চায়না দোয়ারী জাল, আমব্রেলা জাল অপসারণ করছি। জলজ প্রাণির সুরক্ষা এবং দুষণের হাত থেকে চলনবিলকে রক্ষা করতে জনসচেতনতা প্রয়োজন।
‘চলনবিল রক্ষা আন্দোলন’র সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, চলনবিলের নদীসহ সকল জলাধার পুনঃখনন, আন্তঃসংযোগ স্থাপন, দখলমুক্ত করে সীমানা নির্ধারণ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার রোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা, চলনবিলের মৎস্যজীবীদের সুরক্ষিত রাখার মাধ্যমে চলনবিলকে রক্ষা করতে হবে। যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন করলে গণশুনানীর ব্যবস্থা এবং পরিবেশগত প্রভাব নিরুপন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজন গবেষণা। চলনবিল উদ্ধার, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে ‘চলনবিল কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা যেতে পারে।