বাসস
  ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:১৮

সাহাবি আবু ওয়াক্কাস গড়েছিলেন লালমনিরহাটের ‘হারানো মসজিদ’

লালমনিরহাট, ৩ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ঐতিহাসিক ”হারানো মসজিদ” প্রাচীনতম মসজিদ গুলোর মধ্যে অন্যতম। যার নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘জামেয়’-আস্ সাহাবা জামে মসজিদ। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের প্রাচীনতম নিদর্শন সমূহের মধ্যে অন্যতম লালমনিরহাটের জামেয়-আস্ সাহাবা জামে মসজিদ। প্রায় ১৪শ’ বছর আগে নির্মিত এশিয়া মহাদেশের সর্বপ্রথম মসজিদ হিসেবে মনে করা হয়। রংপুর- কুড়িগ্রাম মহাসড়কের এক কিলোমিটার দক্ষিণে লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস মৌজায় অবস্থিত এ মসজিদ।

১৯৮৬ সালের দিকে আশ্চর্যজনক ভাবে লালমনিরহাটে পাওয়া যায় এ প্রাচীন মসজিদ, যা বাংলাদেশের মুসলমানদের আগমনের প্রারম্ভিক ইতিহাসের রাজসাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উল্লেখিত মসজিদটির উদ্ধারের ঘটনা :

লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামের একটি জঙ্গলের আড়ার মাঝে আবিষ্কৃত হয় এ হারানো মসজিদটি। এক সময় স্থানীয় লোকজন  জীবজন্তু ও সাপ-বিচ্ছুর ভয়ে এ জঙ্গলের আড়াটির ভেতরে প্রবেশ করত না।পড়ে ১৯৮৩-৮৪ সালে স্থানীয়রা এ জঙ্গলের আড়াটি চাষাবাদের জন্য পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়। পড়ে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে গিয়ে তারা দেখে জায়গাটি সমতল জমি থেকে উঁচু এবং সেখানে রয়েছে প্রায় সাত থেকে আটটির মতো মাটির উঁচু টিলা।

জায়গাটি সমতল করার জন্য খনন শুরু হলে সেখানে প্রাচীন কালের তৈরি প্রচুর ইট পাওয়া যেতে থাকে। যে ইটগুলোতে অঙ্কিত কিছু নান্দনিক ফুল। সবাই ভেবে নিয়েছিল পুরনো কোনো জমিদার কিংবা রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ হতে পারে এটি।

কিন্তু ১৯৮৬ সালের ১০ মহররমের একটি ঘটনা তাদের স্থানীয়দের ভাবিয়ে তুলে।

আইয়ুব আলী (৫৭) নামের এক ব্যক্তি অন্য অনেকের মতো ইটের স্তূপ থেকে ইট কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে দেখেন ইটের ওপর কিছু একটা লেখা। পড়ে লেখা স্পষ্ট ভাবে দেখার জন্য  পানিতে ভালোমতো ধুয়ে দেখতে পান এটি কোনো প্রাচীন শিলালিপি। যাতে লেখা আছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯।

পড়ে স্থানীয় লোকজন বুঝতে পাড়ে, এটি কোনো হারানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। পড়ে তারা সতর্কতার সঙ্গে মসজিদটির উদ্ধারকাজ চলাতে থাকে। পড়ে আবিষ্কার হয় মসজিদের মেহরাব,  খুতবা দেওয়ার মিম্বার ইত্যাদি। ২১ ফুট চওড়া ও লম্বা এ মসজিদের চারটি খুঁটি ছিলো, যার দুটিই ধ্বংস হয়ে গেছে। পরে সেখানকার লোকজন মসজিদটিতে টিন দিয়ে নতুন একটি মসজিদ নির্মাণ করে নামাজ আদায় করা শুরু করেন ।

তাঁর পর, মসজিদটি আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে সেই সময়ের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রাচীনতম এ আলামত দেখে স্থানীয় আলেম সমাজ ও ইসলামিক চিন্তাবিদগণ মনে করেন

মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৩শ বছর আগে ৬৯ হিজরিতে। ধারণা করা হয়, হজরত আবু ওয়াক্কাছ (রা.) এ অঞ্চল দিয়েই চীনে পাড়ি জমিয়েছিলেন আর যাতায়াতের সময় এখানেই তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে যার চীনের বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে তাঁর নির্মিত মসজিদ ও তাঁর সমাধি রয়েছে। এ ধারণার থেকেই আরো ভালো করে বোঝা যায় এ হারানো মসজিদটি সাহাবি আবু ওয়াক্কাছ (রা.) নির্মাণ করেছেন, কেননা

রোমান ও জার্মান ইতিহাসবিদদের লেখায় আরব ও রোমান বণিকদের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাকে বাণিজ্যিক পথ হিসেবে ব্যবহারের কথা লিপিবদ্ধ আছে এবং বেশ কয়েকটি চলমান গবেষণায় ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়।

ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিল দাবি করে বলেন, খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পার ধরে সিকিম হয়ে চীনের মধ্য দিয়ে আরব ও রোমান বণিকদের বাণিজ্য বহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণ রয়েছে তাঁদের কাছে।

এ মসজিদটি ৬৯০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৬৯ হিজরিতে নির্মিত হয়। এ প্রাচীন মসজিদ পুনঃনির্মাণে ৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান  দেলওয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে এ দিন অনুষ্ঠিত হয় ইসলামি মহাসম্মেলন। নতুন করে এ মসজিদের ভিত্তিস্থাপন করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হজরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর ও ফিলিস্তিনের মসজিদে আকসার র্গ্যান্ড ইমাম শায়খ আলি উমর ইয়াকুব আল-আব্বাসি। সাহাবা মসজিদকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে তোলা হবে আস-সাহাবা কমপ্লেক্স।

উল্লেখ্য যে, ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে স্থানীয়রা মসজিদটি আবিষ্কার করে। ইসলামিক লেখক মতিউর রহমান বসনিয়া রচিত ‘রংপুরে দ্বীনি দাওয়াত’ নাম বইতে এ মসজিদের কথা তুলে ধরা হয়। রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ থেকেও জানা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আম্মা বিবি আমেনার চাচাতো ভাই হজরত আবু ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে আসেন। এছাড়াও ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত দেশর গণমাধ্যমসহ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে  এ মসজিদের সংবাদ প্রচার হয়েছে। বর্তমানে

প্রতিদিন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে বহু পর্যটক এ মসজিদটি দেখতে আসেন। অনেকেই এখানে এলে অন্তত এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।