শিরোনাম
সাতক্ষীরা, ৬ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জনবল সংকট ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির অভাবে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
রি-এজেন্টের অভাবে প্রায় এক মাস ধরে ৫শত শয্যার এ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্ধ রয়েছে রক্তের সিবিসি পরীক্ষা। এছাড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের একমাত্র সিটি স্ক্যান মেশিনটিও প্রায় দুই মাস ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। এতে ব্রেইন স্ট্রোকের মতো স্পর্শকাতর রোগীদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে বাইরের প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। ফলে রোগীদের একদিকে যেমন ভোগান্তি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়। অপরদিকে, এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সবমিলিয়ে জেলার ২৩ লাখ মানুষ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা থেকে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এদিকে, জনবল সংকটের মধ্যেও প্রতিদিন আউটডোরে (বহির্বিভাগ) গড়ে প্রায় দুই হাজার এবং ভর্তিকৃত গড়ে প্রায় আরো ৫ শতাধিক রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন হাসপাাতলের চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য কর্মীরা।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিনিয়র, জুনিয়র এবং সহকারী সার্জনসহ মঞ্জুরীকৃত পদে মোট চিকিৎসক থাকার কথা রয়েছে ১০১ জন। তার বিপরীতে রয়েছে ৬৫ জন। হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৩৬ জন চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালটিতে নার্সসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর মঞ্জরীকৃত পদে জনবল থাকার কথা রয়েছে মোট ২৬৬ জন। তার বিপরীতে রয়েছে ২৪১ জন। হাসপাতালটিতে নার্সসহ অন্যান্য পদে ঘাটতি রয়েছে ২৫ জন। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর মঞ্জুরীকৃত পদে কর্মচারী থাকার কথা ৯১ জন। তার বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৪৪ জন। ঘাটতি রয়েছে এখনো ৪৭ জন।
চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা জানান, কোটি কোটি টাকার ব্যয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংকটের কারণে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ছে। জনবল সংকট ও হাসপাতালের পরীক্ষারগারের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা ঠিকমত চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না।
সম্প্রতি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু পুত্রের চিকিৎসা নিতে আসা শহরের রাজারবাগান এলাকার সাংবাদিক আসাদুজ্জামান মধু জানান, হাসপাতালটিতে জনবল সংকটের কারনে চিকিৎসা সেবা কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া রি-এজেন্টের অভাবে প্রায় এক মাস ধরে রক্তের সিবিসি পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে এবং রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের একমাত্র সিটি স্ক্যান মেশিনটিও প্রায় দুই মাস ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। এরফলে রোগীদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে বাইরের প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। তিনি আরো বলেন, হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবার মান আগের থেকে এখন অনেক ভালো। তবে, গাইনী বিভাগের চিকিৎসা সেবা বেশী ভালো বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মেহেরুন নেসা নামের একজন রোগীর স্বজন জানান, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিবিসি পরীক্ষার জন্য নেয়া হয় মাত্র ১৫০ টাকা। সেটা বাইরের কোন ক্লিনিক থেকে করতে হলে ৪০০ টাকা পড়ে যায়। যেটা আমাদের মতো গরীব মানুষের জন্যই খুবই কষ্টকর। সরকারী হাসপাতালে গরীব লোক ছাড়া বড় লোক কেউ তো তেমন সেবা নিতে আসেনা। তিনি আরও বলেন, এখানে বিশেষজ্ঞ ও ইন্টার্নি চিকিৎসদের ব্যবহারে মন ভরে যায়। দুই একজন নার্স ছাড়া সকলের ব্যবহার ভালো।
ফুলবিবি নামে একজন রোগীর স্বজন বলেন, শ্যামনগরের গাবুরা থেকে রোগী নিয়ে এসেছি। সাতক্ষীরা শহরের কিছুই চিনিনা। আমার রোগী আনা মাত্র রোগী দেখে কিছু পরীক্ষা-নিরীাক্ষা করতে বলে। সেই ডাক্তার শহরের একটি ক্লিনিকের কথা বলে দেয়। ওই ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করালে রোগী দেখবেনা। রোগীর অক্সিজেন দেওয়া। কিভাবে নিয়ে যাবো বলেন। সরকারি হাসপাতালে এসেছি বিনামূল্যে সেবা নেব বলে। বেসরকারি ক্লিনিকে গেলে বেশি খরচ পড়বে। পরে ডাক্তারের কাছে অনেক অনুরোধ করে মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি।
সাতক্ষীরা শহরের ইটাগাছা এলাকার মোছলেমা বেগম ভর্তি রয়েছেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার পুত্র বধূ হালিমা বেগম জানান, তার শাশুড়ি মোছলেমা বেগম হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন দিন আগে ভর্তি করি। এখন ডাক্তার সিটি স্ক্যান করতে বলেছেন। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট থাকায় আমাদের বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করতে হচ্ছে। এ কারণে আমাদের ভোগান্তি পেতে হচ্ছে। তাছাড়া সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করতে এক হাজার টাকা নিতো। আর বাইরে প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে সিটি স্ক্যান করলে ৪ হাজার টাকা নিচ্ছে।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট ইনচার্জ আব্দুল হালিম জানান, প্রতিদিন এখানে গড় প্রতি ২০ থেকে ৩০টি সিটি স্ক্যান পরীক্ষা হয়ে থাকে। গত দুই মাস যাবত মেশিনটির যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে রোগীরা এসে পরীক্ষা করাতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী বলেন, হাতপাতালের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের কেউ কিছু করতে পারেন না। এ সিন্ডিকেটের কাছে পুরো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জিম্মি।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ কুদরত-ই-খুদা জানান, জনবল সংকটের কারনে বহির্বিভাগে প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে। ফলে হাসপাতালের সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সিবিসি ও হরমোনের রি-এজেন্ট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সিবিসি রি-এজেন্ট যেটা দেওয়া হয়েছিলো সেটার মেয়াদ ছিলো মাত্র দুই মাস সেজন্য সেগুলো ফেরত দেয়া হয়েছে। বেশি মেয়াদের রি-এজেন্ট দিতে বলা হয়েছে। এজন্য কোম্পানির বিলও আটকে রাখা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে বেশী মেয়াদের রি-এজেন্ট না দেওয়া পর্যন্ত বিল দেয়া হবে না। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পেয়ে যাবো। তখন সিবিসি পরীক্ষা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা মেরামতের জন্য ৫৮ লাখ টাকা দরকার। মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এখনও অনুমোদন পাওয়া যায়নি। অনুমোদন পেলেই সিটি স্ক্যান চালু করা হবে।
উল্লেখ্য ২০১১ সালে সীমিত পরিসরে শহরের কাটিয়া এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে শহরতলীর বাঁকাল এলাকায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ভাবে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়।