বাসস
  ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬

উপকূলের সর্বত্র সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার

বরগুনা, ৯ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : কুয়াকাটা-সোনাকাটা সাগর সৈকত, হরিণঘাটা, ফাতরার জংগল, সোনাকাটার ইকোপার্কসহ উপকূলীয় এলাকার শহর-বন্দর বা প্রত্যন্ত পল্লীর কোনায় কোনায় পৌঁছে গেছে সৌর বিদ্যুৎ।

সরকারীভাবে প্রতিটি উপজেলার পিআইও অফিস উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার মাধ্যমে বিনামূল্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সৌর বিদ্যুত সুবিধা প্রদান করায় এর ব্যবহারের মাত্রা এখন ব্যাপকহারে সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ছোট ছোট নৌকা, ট্রলার, বনের মধ্যে ছোট্ট কুঁড়ে কিংবা সাগরপাড়ের জেলে পল্লীর সারি সারি ঘর আলোয় ঝলমলে। কোথাও কোথাও রেডিও, টেলিভিশন বা মিউজিক প্লেয়ারে গান-বাজনার শব্দও শোনা যায়। রাতের আধাঁর দূর করতে জ্বালানী তেল কেরোসিন কেনা ছেড়ে দিয়েছেন লোকজন লোডশেডিংয়ের ঝামেলা নেই।

কর্মীদের খবর দিলেই বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের স্থাপন দিয়ে যায়। খরচও তুলনামূলক অনেক কম। বরগুনা-পটুয়াখালীর বিভিন্ন গ্রাম ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকাগুলোর স্থানীয় লোকজন ব্যাপক হারে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলোর চাহিদা মেটাচ্ছেন। শুধু গ্রামই নয়, জেলা-উপজেলা শহরে বিদ্যুতের পাশাপাশি মানুষের বাসা-বাড়ি কিংবা অধিকাংশ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে। হাঁস-মুরগীর খামারে জ্বলছে সৌরবাতি। কৃষি জমিতে সৌর সেচ পদ্ধতি চালু হয়েছে আরো ১৪ বছর আগে। এখন সড়কবাতি জ্বালানোর কাজেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে।

সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা জানান, রাতে বাতি জ্বালানোসহ বৈদ্যুতিক পাখা ও টেলিভিশন চালানোর মতো সুবিধা পাওয়ায় সৌরবিদ্যুৎ এ অঞ্চলে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পানি উত্তোলনেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার চলছে।

তাছাড়া যেসব এলাকায় বিদ্যুত পৌঁছাতে এখনও সময়ের দরকার সেই এলাকাগুলোতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত সবাই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন। শহরাঞ্চলে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলাকালীন বা বিদ্যুত থাকা অবস্থায়ও আলোর চাহিদা মেটাতেও সৌরশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাপক হারে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী দপ্তরগুলোর মতো জরুরী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুতের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বেশ পুরাতন। এ অঞ্চলে বিদ্যুত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান খোদ পল্লী বিদ্যুতের অফিসগুলোতেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফেরীঘাটগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, শহর ও বন্দরে সৌরবিদ্যুৎ সড়কবাতি অন্ধকার দূর করছে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন পপকর্ন বিক্রেতারা। পপকর্ন বিক্রয় ভ্যানে সৌরপ্যানেল ও ব্যাটারির সাহায্যে মোটর চালনা করা হচ্ছে।

সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বরগুনার কৃষকরা সেচ দিচ্ছেন শত শত একর জমিতে। সূর্যালোকের সাহায্যে ফসলী জমিতে এই সেচ ব্যবস্থা কৃষকদের জ্বালানী তেল বা বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীলতার হাত থেকে বাঁচিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ২০১০ সাল থেকে বরগুনায় ৬ টি গ্রামে ৬টি সোলার ইরিগেশন পা¤িপং সিস্টেম ৪০ একর করে জমিতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি সরবরাহ করে যাচ্ছে।

ছোট-বড় প্রায় শতাধিক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে জেলার গ্রাহকদের সৌরবিদ্যুত ব্যবস্থার চাহিদা পূরণ করছে। ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকজন বিপণন কর্মকর্তা আলাপকালে জানান, মাত্র একহাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে চাহিদা ও বিদ্যুত ক্ষমতা অনুযায়ী সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপন (ইনস্টল) করেন তারা। মোট দামের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা এককালীন পরিশোধ করে বাকি টাকা ৩০ থেকে ৪০ কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ থাকায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা গ্রাহকদের কাছে বেশ সুবিধাজনক ও ব্যবহারযোগ্য হয়েছে।

সৌর বিদ্যুতের যন্ত্রাংশের সেটের এককালীন ক্রয়ের ক্ষেত্রে মূল্য প্রায় অর্ধেক এ নেমে আসে বলে জানালেন বেশ কয়েকটি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের কর্নধাররা। এ ক্ষেত্রে সামর্থবান লোকজন কিস্তির ঝামেলায় যাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন।

শহর ও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর পাশাপাশি উপকূলীয় সাগরতীরবর্তী তালতলী ও পাথরঘাটা, কলাপাড়া, গলাচিপা রাঙ্গাবালীর মানুষেরা সৌরবিদ্যুতে বেশী উপকৃত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা খলিফা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক গাজী মতিয়ার রহমান।

বরগুনা সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. আ. ওহাব বলেন, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা অনেক বেড়েছে। তারা দেশ-বিদেশের সমসাময়িক বিষয়গুলো স¤পর্কে প্রতিনিয়ত ওয়াকিবহাল হচ্ছেন।

পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকাতেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র, রাডার স্টেশন, সাবমেরিন স্টেশন, -সবখানেতেই রয়েছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার।

আমতলী সরকারী কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান, সহকারী অধ্যাপক উত্তম কুমার কর্মকার বলেন, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বিদুতের বাড়তি চাহিদা থেকে আমাদের মুক্তি দিচ্ছে। উপযোগিতা থাকায় উপকূলীয় এলাকায় (উইন্ডমিল) বায়ু শক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেটি সৌরশক্তির চেয়েও কম ব্যয়ের হবে।

বরগুনার আমতলীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলম জানান, প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দ্রুত উপকূলীয় এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করছে। তিনি জানিয়েছেন, এখন সাগরপাড়ের মানুষও রাতে   সৌর বিদ্যুতের আলোয় কাজ করছে। বিনোদন ও শিক্ষার জন্য টেলিভিশন দেখছে। দেশের প্রতিটি এলাকায় ডিজিটাল সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।